বিভিন্ন স্থানে অর্ধশত নেতা-কর্মী আহত, ৬০ জন আটক-পুলিশের ধরপাকড়ের মধ্যেও ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর

সারা দেশে ব্যাপক গাড়ি ভাঙচুর ও পুলিশের ধরপাকড়ের মধ্য দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়েছে। পুলিশের বাধায় কোথাও কোথাও হরতাল-সমর্থকেরা রাস্তায়ই নামতে পারেনি। লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে হরতাল-সমর্থকদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ।


এসব ঘটনায় পুলিশসহ অর্ধশত নেতা-কর্মী আহত হন। বুধবার রাতে ও গতকাল বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশ অন্তত ৬০ জনকে আটক করেছে।
১৮ দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জামিন নামঞ্জুর ও কারাগারে প্রেরণ এবং ইলিয়াস আলী গুমের প্রতিবাদে এই হরতাল কর্মসূচি পালিত হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী, বিএনপির নেতা-কর্মী ও পুলিশের বরাত দিয়ে ঢাকার বাইরে প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
কেরানীগঞ্জ (ঢাকা): হরতাল-সমর্থকেরা কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে দফায় দফায় হামলা চালিয়ে শতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করে। সকাল আটটার দিকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার নেকরোজবাগ এলাকায় তারা রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি এবং যানবাহন ভাঙচুর করে। পুলিশ তাদের ধাওয়া দিলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
বেলা ১১টার দিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমানের সমর্থকেরা হযরতপুরের ইটাভাড়া ও মানিকনগরের কলাতিয়া হযরতপুর সড়কে গাড়ি ভাঙচুর করে। রুহিতপুর ইউনিয়নে সৈয়দপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়ও গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ ছাড়া নয়াবাজার, কালিন্দী, কোনাখোলা, চরওয়াসপুরে হরতাল-সমর্থকেরা গাড়ি ভাঙচুর করে।
এদিকে কালিন্দী এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী একটি মিছিল বের হয়। দুপুরের দিকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা রুহিতপুর ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক মো. আক্তারের বাড়িতে হামলা চালায়। এতে লিটন, রকি, রাজু ও জাহাঙ্গীর নামে চারজন আহত হয়।
নারায়ণগঞ্জ: সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ শহরের ডিআইটি বাণিজ্যিক এলাকায় জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। হরতালের সমর্থনে শহরের মণ্ডলপাড়া সিটি করপোরেশন ভবনের সামনে থেকে মিছিল বের করে বিএনপি। মিছিলটি মণ্ডলপাড়া এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিপেটা করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে আহত হন শহর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল, নগর যুবদলের আহ্বায়ক মাকছুদুল আলম খন্দকার, যুবদলের কর্মী জুলহাস, সুমন, রায়হানসহ অন্তত ১০ জন। পুলিশ মাকছুদুল আলম খন্দকারসহ সাতজনকে আটক করেছে।
এদিকে বিপুলসংখ্যক মহিলা পুলিশ বিএনপির কার্যালয় অবরুদ্ধ করে রাখে। ফলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলীয় কার্যালয় থেকে বের হতে পারেননি। আহত এ টি এম কামাল ও জুলহাসকে মণ্ডলপাড়ায় নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ টি এম কামাল অভিযোগ করেন, পুলিশ বিনা উসকানিতে তাঁদের নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করেছে।
তবে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর কাদের জানান, জনগণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় লাঠিপেটা করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হয়। জেলা বিএনপি পুলিশের হামলা ও ধরপাকড়ের প্রতিবাদে কাল শনিবার বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে।
নরসিংদী: সকাল আটটার দিকে জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের করার চেষ্টা করলে পুলিশের বাধায় তা ভেস্তে যায়। ঢাকায় বিএনপির শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবির খোকনকে গ্রেপ্তারের খবরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা বিএনপির সহসভাপতি রোকেয়া আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক দ্বীন মোহাম্মদ ও শহর বিএনপির সভাপতি গোলাম কবীর নেতৃত্বে শহরের গোলাপচত্বর থেকে পুনরায় মিছিল বের করা হলে পুলিশের বাধায় এটিও ভেস্তে যায়। পরে দুপুরে সদর উপজেলার বাদুয়ারচর এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলীয় রেললাইনের ওপর আগুন ধরিয়ে দেন বিএনপির কর্মীরা। তবে রেললাইনের কোনো ক্ষতি হয়নি।
গাজীপুর: দুপুরে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় পিকেটাররা কয়েকটি বাস ভাঙচুর করলে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সদর উপজেলার পুবাইলের মাজুখান ব্রিজের পাশে পিকেটাররা একটি পিকআপ জ্বালিয়ে দেয়। এদিকে বুধবার রাতে পুলিশ টঙ্গী থেকে সাতজন, কালীগঞ্জ থেকে তিনজন ও কালিয়াকৈর থেকে বিএনপির দুই কর্মীকে আটক করে।
যশোর: সকালে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারসংলগ্ন এলাকা থেকে হরতাল-সমর্থনকারীরা একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি শহর ঘুরে এম কে সড়কের পুরোনো পৌর ভবন এলাকায় পৌঁছলে পুলিশ লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করা চেষ্টা করে। এ সময় যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল জলিল ভূঁইয়া জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি নির্মল কুমার বিটের গলা টিপে ধরেন। বিষয়টি অস্বীকার করে ওসি আবদুল জলিল ভূঁইয়া বলেন, মিছিলে লাঠিপেটা বা কাউকে গলা টিপে ধরা হয়নি। জনদুর্ভোগ কমাতে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করা হয়েছে।
এদিকে হরতাল চলাকালে যশোরের মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির কার্যালয় এবং উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র শহীদ মো. ইকবাল হোসেনের বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। এ সময় চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। হরতালবিরোধীদের ছোড়া ইটের আঘাতে যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) জাকির হোসেন খানসহ পাঁচজন আহত হয়েছেন। এদিকে আওয়ামী লীগের মিছিলে ইটপাটকেল ছোড়ার অভিযোগে বিএনপির চার কর্মীকে আটক করা হয়েছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাকির হোসেন খান জানান, দুটি বোমা বিস্ফোরণের আলামত পাওয়া গেছে।
কুষ্টিয়া: কুষ্টিয়া শহরের বড় বাজার ও মজমপুর গেট থেকে সকালেই বিএনপির আটজন নেতা-কর্মীকে আটক করে পুলিশ। পরে বড়বাজার এলাকায় জেলা বিএনপির সভাপতি মেহেদী রুমীর নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হলে পুলিশ লাঠিপেটা করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
নোয়াখালী: সকাল সাতটার দিকে নোয়াখালী শহরের থানা কাউন্সিল এলাকায় একটি ট্রাক ও দত্তবাড়ির মোড়ে একটি বাস ভাঙচুর করে পিকেটাররা।
নাটোর: সকালে নাটোর শহরে মিছিল বের করে হরতাল-সমর্থকেরা। পুলিশ মিছিলটিতে বাধা দিলে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় হরতাল-সমর্থকেরা শহরের একতার মোড়ে একটি ট্রাক ও চারটি অটোরিকশা ভাঙচুর করে।
লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর শহরে শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। সকালে যুবদল ও ছাত্রদল শহরে মিছিল সমাবেশ করে। পরে শহরের বিভিন্ন সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা অবরোধ করে রাখে হরতাল-সমর্থকেরা। সদর, রামগঞ্জ, রামগতি, রায়পুর ও কমলনগর উপজেলা থেকে বিএনপির ২২ কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ।
পটিয়া (চট্টগ্রাম): চট্টগ্রাম-কক্সবাজার আরকান সড়কের পটিয়া কমলমুন্সির হাট এলাকায় সড়কের ওপর টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে হরতাল-সমর্থকেরা। এ সময় পিকেটারদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে আনসার সদস্য নুরুল ইসলাম আহত হন। পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে দুই হরতাল-সমর্থককে আটক করে।

No comments

Powered by Blogger.