ইতিহাসের কাছে ঔপন্যাসিকের দায় by মো. আনোয়ার হোসেন

হুমায়ূন আহমেদের রাজনৈতিক উপন্যাস দেয়াল-এর প্রেস কপি পড়ার সুযোগ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. আনোয়ার হোসেনের। উপন্যাস পাঠের আলোকেই লেখা এই রচনা। লালমাটিয়াতে লুৎফা ভাবির (কর্নেল তাহেরের স্ত্রী) বাসায় আমরা একত্র হয়েছি। আমার অন্য ভাবিরাও আছেন।


আছে দুই বোন। আরও আছে আমাদের ছেলেমেয়েরা—নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি।
একটি পাণ্ডুলিপি পড়া হবে। দেয়াল শিরোনামের পাণ্ডুলিপিটি আমার হাতে এসেছে এর দিন সাতেক আগে। সে সম্পর্কে পরে আরও একটু বলব। বৈঠকে উপস্থিত বড়রা, অর্থাৎ ভাবিরা এবং আমরা ভাইবোনেরা—আমাদের মন চলে গেছে এখন থেকে প্রায় ৩৯ বছর আগের একটি দিনে। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর কোল ঘেঁষে একটি বাংলোর নাশতার টেবিলে। আমরা একটি উপন্যাস পড়ছি। আজকের বৈঠকের বড়রা সবাই ছিলেন সেই টেবিলের চারপাশে। আজ কয়েকজন নেই। কর্নেল তাহের, আবু ইউসুফ আর বাহার। আমার তিন ভ্রাতা। বড় অসময়ে আমরা তাঁদের হারিয়ে ফেলেছি। সেদিন হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে উপন্যাসটি আমরা এক বসায় শেষ করেছিলাম। একটি সাহিত্য সাময়িকীতে প্রথম তা বেরিয়েছিল। কর্নেল তাহেরের প্রবল আগ্রহে সে উপন্যাসটি শোনা। যোগসূত্র অবশ্য আমি। সে নন্দিত উপন্যাসের প্রথম সংবাদটি আমি দিই পরিবারে।
কী আশ্চর্য যোগাযোগ! আজ আমরা আবার একত্র হয়েছি মিসেস তাহেরের বসার ঘরে। সময় আমাদের জীবিতদের নিয়ে এসেছে এই বর্তমানে। ৩৯ বছর আগের ছুটির দিনের সকালে কর্নেল তাহেরের বাংলোর নাশতার টেবিল থেকে বহমান স্বাস্থ্যবতী শীতলক্ষ্যা ছিল আমাদের খুব কাছে, দৃষ্টিসীমায়। নদীর নির্মল হাওয়া আমাদের দোলা দিচ্ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে সে উত্তাল সময়টায় সমাজ বদলের আপাত-অসাধ্য সব স্বপ্নে আমরা বিভোর ছিলাম। সে স্বপ্নযাত্রায় হুমায়ূনকেও সঙ্গী করতে চেয়েছিলেন তাহের।
আজ সাতমসজিদ রোডের নানা যানবাহনের তীব্র শব্দ ও প্রচণ্ড কোলাহল। ভাবির বসার ঘরে পাণ্ডুলিপি পড়ার জন্য যে স্থিত শান্ত পরিবেশটি দরকার, তাতে বারবার বাধা হচ্ছিল। আমরা তাই ভেতরের দিকে ভাবির শোবার ঘরে জানালা বন্ধ করে বিছানা, মেঝে এবং মোড়ায় খুব ঘন হয়ে বসে পাণ্ডুলিপিটি পড়েছি। পুরোটা নয়। শুরুর কিছু অংশ এবং ওসব পাতা যেখানে কর্নেল তাহের আছেন। পুরোটাই এক বসায় শোনার ইচ্ছা ছিল। যেমনটা হয়েছিল আগে উল্লিখিত একটি দিনে। কিন্তু সময় বদলে গেছে। কারণে-অকারণে ব্যস্ততা বেড়েছে আমাদের। আমার হাতে সময় কম। যেতে হবে পূর্বনির্ধারিত এক কাজে।
আমি আদ্যোপান্ত পড়েছি পাণ্ডুলিপিটি হাতে আসার পরই। পাণ্ডুলিপির সঙ্গে আমাকে লেখা হুমায়ূন আহমেদের একটি চিঠি আমার হাতে এসেছে ২৮ এপ্রিল রাতে। আমাদের ফুফাতো বোন নন্দিত কথাশিল্পী নাসরীন জাহান ফোন করেছে অনেক দিন পর। বলল, অন্যপ্রকাশের মাজহার একটু কথা বলবেন। মাজহার সংবাদটি দিলেন এবং চিঠি, পাণ্ডুলিপি ও তাঁর প্রকাশনা থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত হুমায়ূনের কয়েকটি বই সে রাতেই পাঠিয়ে দিলেন। ফোনে মাজহারকে বহু বছর আগের একটি ঘটনার কথা বললাম। কর্নেল তাহেরের আগ্রহে হুমায়ূন আহমেদকে আমার ভাঙা মোটরসাইকেলে করে নারায়ণগঞ্জের বাসায় নেওয়ার কথা ছিল। তা আর হয়নি। মাজহার বললেন, কী আশ্চর্য! হুমায়ূন আহমেদ তো সে কথা বলেছেন আপনাকে লেখা তাঁর চিঠিতে এবং দেয়াল উপন্যাসে।
এবার আসি সে উপন্যাসের কথায়। চিঠিতে হুমায়ূন লিখেছেন, ‘পাণ্ডুলিপি পড়ার সময় মনে রাখবে, আমি উপন্যাস লিখতে বসেছি। ইতিহাস না। আমি লেখক মানুষ, উপন্যাসই লিখব। তোমরা লিখবে ইতিহাস।’ পাণ্ডুলিপি পড়ার সময় সে কথা মনে রেখেছি। তার পরও কথা থাকে। হুমায়ূন আহমেদের দেয়াল উপন্যাসে ইতিহাসের চরিত্রদের নিয়ে যে কথা হয়, তাঁদের মুখে যে কথা বলান হুমায়ূন আহমেদ, লাখো পাঠকের কাছে তা-ই হয়ে যায় ইতিহাস। ধারণা করি, সে কথা মনে রেখেই হুমায়ূন পাণ্ডুলিপিটি পাঠিয়েছেন কয়েকজনের কাছে এবং আমাকেও। পাণ্ডুলিপির গায়েই আমি আমার মন্তব্যও লিখেছি। যেমন কর্নেল ফারুক প্রসঙ্গ। মন্তব্যে লিখেছি, ‘সে সময় মেজর ফারুক ছিলেন ল্যান্সারের একজন অফিসার, অধিনায়কও নন। বইতে আছে আর্টিলারির অধিনায়ক। তাঁর ভায়রা মেজর রশিদ ছিলেন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির অফিসার। ১৯৭১-এর নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর ফারুক মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মেজর রশিদ যোগ দেন ২৯ অক্টোবর তারিখে। তেমন কোনো যুদ্ধ এঁরা করেননি। ফারুক-রশিদের পরবর্তী কার্যকলাপে এও মনে করা হয় যে পরিকল্পিতভাবে এঁদের মুক্তিযুদ্ধের একেবারে শেষে পাঠানো হয় পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে। এমন ছোটখাটো মন্তব্য আছে আরও কিছু ক্ষেত্রে।
আমাকে চিঠিতে যদিও হুমায়ূন লিখেছিলেন, তিনি উপন্যাস লিখছেন, ইতিহাস নয়। তার পরও হুমায়ূনের কলমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ফারুকের যে প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, বিশেষ করে একজন ধর্ষক পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন শামসকে নিজ হাতে গুলি করে হত্যা করা—তাতে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে মনে হতে পারে, ফারুক তো মুক্তিযুদ্ধের এক রঙিন নায়ক। আর এমন একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে জীবন দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু! বাস্তব চিত্রটি হলো ফারুক প্রকৃত কোনো মুক্তিযুদ্ধেই অংশ নিতে পারেননি। খুব সম্ভব তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঠানো চর।
১১ মে প্রথম আলোয় দেয়াল-এর কিছু অংশ ছাপিয়েছে। আমি একটু অবাক হয়েছি। দিন কয়েক আগে আমি নাসরীন জাহানকে ফোন করে জানিয়েছিলাম, আমি ও লুৎফা ভাবি পাণ্ডুলিপিটি পড়ে শেষ করেছি। মন্তব্যও দিয়েছি। তা এখন হুমায়ুনকে পাঠানো দরকার। সে জানাল, মাজহার চীন গিয়েছেন। ফিরে এলেই যোগাযোগ করবেন। হুমায়ূন আমাকে যে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন তা অসমাপ্ত। তাঁর চিঠি অনুযায়ী আরও বিষয় যুক্ত হবে তাতে। তাই ধারণা ছিল, আরও পরে তা প্রকাশিত হবে। এর মধ্যে হুমায়ূন ফিরে এসেছেন দেশে এবং দেয়াল-এর কিছু অংশ ছাপাও হয়েছে। এক অভূতপূর্ব সাড়া পড়েছে এক দিনেই। আমার ছেলে ইন্টারনেটে প্রকাশিত নানা মন্তব্য সম্পর্কে বলল। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখাটিও পড়েছি। আমি অতি সামান্য ব্যক্তি। বন্ধু হিসেবেই হয়তো হুমায়ূন আমাকে চিঠি লিখেছেন এবং পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশের আগে তা পড়ার সুযোগ দিয়েছেন। আরও একটি কারণ হয়তো এই যে তাহের এবং তাঁর পরিবার সম্পর্কে দেয়াল উপন্যাসে বিবৃত তথ্যাবলি যেন যথাসম্ভব সত্যনিষ্ঠ হয় তা দেখে দেওয়া। আমি সে বিষয়ে পাণ্ডুলিপিতে মন্তব্যও করেছি।
আমি ভাবিনি দেয়াল উপন্যাস নিয়ে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করব। আমার মা, ভাই কর্নেল তাহের এবং আমি নিজেও উপন্যাসে এসেছি। একসঙ্গে পাণ্ডুলিপি পড়ার সময় প্রবল ভাবাবেগ আমাদের আপ্লুত করেছে। গলা ধরে এসেছে। চোখের তপ্ত পানি গড়িয়ে পড়েছে। তার পরও নিরাসক্ত মনে ভাববার চেষ্টা করেছি। উপন্যাস ও ইতিহাস নিয়ে ভেবেছি। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ূনের কাছে তো অতি অবশ্যই উপন্যাস। আর লাখো পাঠকের কাছে? উপন্যাসের সব চাহিদা তো বটেই। তার পরও আরও কিছু। ইতিহাস পাঠ এবং সত্যের অনুসন্ধান। হুমায়ূন না বললেও আমি জানি এই মহাশক্তিশালী জাদুকর তা জানেন।
‘কালি, কলম, মন—লেখে তিনজন।’ হুমায়ূন সাহসী মানুষ। তা না হলে বাংলার রক্তাক্ত ইতিহাস নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসতেন না তিনি। রক্ত ঝরার দারুণ জটিল সেই সব ঘটনাবলি, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনীতির নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আছে স্বপ্ন এবং স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তা নিরাসক্ত কিন্তু মানবিক চোখে যথাসম্ভব সত্যের কাছাকাছি করে, পাঠকের কাছে তুলে ধরার দুঃসাহস দেখিয়েছেন হুমায়ূন। সেই মন নিয়েই কালি-কলমে এসেছে দেয়াল।
চার দশক ধরে পাঠক ও ইতিহাসের মাঝখানে খাড়া করা হয়েছে নানা কৃত্রিম দেয়াল—মিথ্যার দেয়াল যা সত্যকে আড়াল করেছে, প্রতিবিপ্লবের দেয়াল যা বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে ম্লান করে দিয়েছে, খলনায়কের দেয়াল যা দিয়ে আসল নায়ককে পাঠানো হয়েছে নির্বাসনে, অবিশ্বাসের দেয়াল যা দিয়ে মানুষের সহজাত বিশ্বাসে চিড় ধরানো হয়েছে এবং দুঃস্বপ্নের দেয়াল যা দিয়ে মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে। হুমায়ূন আহমেদ যদি তাঁর দেয়াল উপন্যাস দিয়ে পাঠকের মনোজগতে খাড়া করা সারি সারি সেসব দেয়াল ভেঙে ফেলতে পারেন, যাতে তাঁরা সত্যকে চিনে নিতে পারে সহজে—তাহলে তার চেয়ে মহান কাজ আর কী হতে পারে? ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন সাহসী হুমায়ূন আহমেদ। যুদ্ধ করছেন নিজের সঙ্গেও। কালের সঙ্গেও তাঁর যুদ্ধ। আগামীকালের খ্যাতি না মহাকালের ডাক শুনে এগিয়ে যাওয়া। কোনটা গুরুত্বপূর্ণ? রবীন্দ্রনাথের সেই অমরবাণী, ‘সত্য যে কঠিন,/ কঠিনেরে ভালোবাসিলাম—/ সে কখনো করে না বঞ্চনা’—তা হুমায়ূন মনে রাখবেন। দারুণ তাঁর উপন্যাসে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম জানতে পারুক আমাদের সবচেয়ে মহান অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা সেই সব হীরণ্ময় মানুষের, যাঁদের আমরা হারিয়ে ফেলেছি। সত্য সন্ধানে তাঁরা ব্রতী হবেন। চিনে নিতে পারবেন ইতিহাসের প্রকৃত নায়কদের। তাঁদের অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবেন।

পুনশ্চ: দেয়াল-এর কিছু অংশ পড়ে কিছু বিষয় বিশেষ করে কর্নেল ফারুক প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের বক্তব্য নিয়ে যাঁরা সমালোচনামুখর হয়েছেন, তাঁদের অনুভূতির সঙ্গে আমি একমত। আমার এ লেখায়ও সে সম্পর্কে বলেছি। তবে তথ্য উৎসের ভ্রান্তি, সময়ের চাপ এবং পাণ্ডুলিপির ওপর মতামত প্রাপ্তির আগেই ছাপা হয়ে যাওয়ায় হুমায়ূনের ফারুক প্রসঙ্গ প্রকাশিত অংশ তথ্যনির্ভর হয়নি। ওই সব পাঠকের কাছে একটি বিনীত অনুরোধ—মোহন জাদুকর হুমায়ূনের থলিতে আরও বহু জাদু আছে। একটু অপেক্ষা করুন। তাঁর সম্পর্কে শেষ কথাটি বলার সময় হয়তো এখনো আসেনি।
মো. আনোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১২ মে ২০১২

No comments

Powered by Blogger.