আইসল্যান্ডকে বদলে দেওয়া আগ্নেয়গিরি by সুমন কায়সার

আগ্নেয়গিরির কাজকারবার দেখতে বহুদিন ধরেই পর্যটকেরা ভিড় জমান আইসল্যান্ডে। নামে ‘আইস’ বা বরফের দেশ এবং শীতপ্রধান হলেও দেশটি বসে আছে যেন অগ্নিকুণ্ডের ওপর। আগ্নেয়গিরির ধোঁয়ার কুণ্ডলী বা এখানে-সেখানে ফুটন্ত পানির উষ্ণ প্রস্রবণ সেখানে চিরচেনা দৃশ্য।


কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এবার সেখানকার একটি অস্থির আগ্নেয়গিরি এমনই খেপেছে যে তামাশা দেখার আগ্রহ থাকলেও অন্তত বিমানে করে সে দেশে যাওয়ার আপাতত কোনো উপায় নেই।
ছাইয়ের মেঘে বিমান পরিবহন বিপর্যস্ত হয়ে বিশ্বের দেশে দেশে আটকা পড়েন হাজার হাজার পর্যটক। বিমান উড়তে না পারায় অনেক বিশ্বনেতা পর্যন্ত পোলিশ প্রেসিডেন্টের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি। কিন্তু এত কিছুর পরও এ দেশেরই ১৭৮৩ সালের ৮ জুনের এক অগ্ন্যুদিগরণের তুলনায় এটি নাকি নস্যি!
ওই সময় তুলনামূলকভাবে নবীন দেশ আইসল্যান্ডে বসবাস ছিল মাত্র ৫০ হাজার লোকের। নবীন এ অর্থে যে, ভূগোলকের প্রায় এক কোণের দেশটিতে মানুষের বসবাস মাত্রই সাড়ে সাত শ বছর ধরে। ১৭৮৩ সালের ৮ জুন সকালে সে দেশের লাকি আগ্নেয়গিরি যে তৎপরতা শুরু করে, এর ফলে পরবর্তী মাত্র কয়েক বছরে প্রাণ হারায় দেশটির পাঁচ ভাগের এক ভাগ মানুষ। ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে মারা যায় আরও হাজার হাজার লোক। লাকির অগ্ন্যুৎপাত আইসল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বিপর্যয়কর দুর্যোগ। দেশের একই এলাকায় এয়াকিউয়াতলুয়োকুটল আর লাকি, মিল বলতে এটুকুই। ধ্বংসক্ষমতার দিক থেকে লাকির সঙ্গে এই বিদ্ঘুটে নামের আগ্নেয়গিরির সাম্প্রতিক তৎপরতার তুলনাই হয় না।
১৭৮৩ সালে লাকি ফুঁসে উঠেছিল এমনই প্রলয়ংকরী শক্তি নিয়ে যে বিশাল একটি ফাটল জন্ম দেয় অনেকগুলো জ্বালামুখ। তাতে টগবগ করে ফুটছিল লাভা। পরের আটটি মাস ধরে ‘লাকাগিগার’ (অর্থ লাকির জ্বালামুখগুলো) আশপাশের অঞ্চলের ওপর উগরে দেয় ৬০০ বর্গ কিলোমিটার ফুটন্ত লাভা। আর যে পরিমাণ বিষাক্ত গ্যাস বের হয়, তা আগের দেড় শ বছরের কোনো উদগীরণে হয়নি। উত্তর গোলার্ধজুড়ে অনুভূত হয়েছিল এর প্রভাব।
লাকির ওই অগ্ন্যুৎপাত বিশ্বে গত এক হাজার বছরের দ্বিতীয় ভয়াবহতম অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা। এর আগে রয়েছে কেবল ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট তামবোরার ঘটনা, যা ঘটেছিল ১৮১৫ সালে। ব্রিটেনের আগ্নেয়গিরিবিশারদ স্টিফেন সেলফের হিসাবে, লাকির শক্তি ছিল এয়াকিউয়াতলুয়োকুটলের এখনকার উদিগরণের চেয়ে ১০০ গুণ বেশি! বিপুল পরিমাণ সালফার গ্যাস উগরে দিয়েছিল লাকি, যা সালফিউরিক এসিড-বিন্দুর মেঘ তৈরি করে। পুব দিকে ভেসে চলা এই মেঘ ইউরোপ পেরিয়ে ক্রমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
নরওয়ে, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন হয়ে আরও এগোতে থাকে কুয়াশার মতো দেখতে লাকির এসিড মেঘ। এর গতিপথে মাঠে কর্মরত কৃষকেরা হঠাৎই মাছির মতো মরে মরে ঢলে পড়তে থাকলে আতঙ্ক দেখা দেয়। কোথা থেকে ওই কুয়াশারূপী মৃত্যুদূত আসছে, ওই যুগে তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। সালফার ডাই-অক্সাইড যে ফুসফুসে থাকা পানির বিন্দুর সঙ্গে মিলে মানুষের শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে, সেটা বোঝেনি কেউ।
শরৎকালে এসে ওই কুয়াশা মিলিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু শিগগিরই দেখা দেয় আরও বড় এক বিপত্তি। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে তাপশোষক সালফার ডাই-অক্সাইড জমা হওয়ার ফলে আসে আড়াই শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ শীত। সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয়েছিল আইসল্যান্ডকেই। সরাসরি অগ্ন্যুৎপাতে কিন্তু মানুষ মারা যায়নি। মারা গেছে এর ফলে যে পরিবেশগত বিপর্যয় হয়েছে, তাতে। বিষাক্ত গ্যাসের কারণে গাছপালা, শস্য ও গবাদিপশু মরে সাফ হয়েছিল। আর মানুষ তাই মারা যায় অনাহারে।
আইসল্যান্ডের মানুষের মনোজগতে এই মর্মান্তিক ঘটনার একটি বিশেষ অবস্থান আছে। তাদের ভাষায় একটি নামও আছে ঘটনাটি বোঝাতে: মডুহারডিনডিন। এর অর্থ ‘কুয়াশার কষ্ট’। ঘন ঘন অগ্ন্যুৎপাতের জন্য দেশের শিশুদের জন্য স্কুলে ভূতত্ত্ব ও লাভা নিয়ে পড়াশোনা করা বাধ্যতামূলক পর্যন্ত করা হয়েছে।
দেশের অন্যতম খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ গুনার কার্লসন বলেন, সামুদ্রিক মাছের প্রাচুর্য না থাকলে ‘কুয়াশার কষ্টের’ সময় মানুষের কষ্ট হতো আরও মারাত্মক। উপকূলে কড মাছের অভাব ছিল না। তবে এর পরও ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেককে সে খাদ্য তুলে দেওয়া যায়নি। ওই সময় আইসল্যান্ড ছিল ডেনিশ রাজ্যের অধীনে। এক হাজার মাইল দূরের কোপেনহেগেন থেকে শাসিত হতো দেশটি। আজকের রাজধানী রিকইয়াভিক তখন কেবলই একটি গ্রাম।
এনলাইটেনমেন্টের প্রভাবে ইউরোপের মানুষের চিন্তাজগতে উন্নতির শুরু হয়েছে, কেটে যাচ্ছে অতিপ্রাকৃত আর কুসংস্কারে বিশ্বাস, এমন সময় আঘাত হেনেছিল লাকি। মানুষের নিজের শক্তির ওপর আস্থায় একটা বড় আঘাত ছিল ওই ঘটনা। প্রগতি আর জীবনের উন্নয়নে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল মানুষ। অধ্যাপক কার্লসন বলেন, যখন মানুষ দেখল নিজেদের জীবনের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কত কম, তখন নিশ্চয়ই বড় একটা ধাক্কা খেয়েছিল তারা। ধর্মগুরুরা তো বলতেই থাকলেন, এ পাপের শাস্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।
অধ্যাপক কার্লসনের ধারণা, আইসল্যান্ডের সমাজের ওপর আরও অপ্রত্যাশিত ধরনের কিছু প্রভাব ফেলেছিল লাকি। দেশের মানুষ নাকি নাচও বন্ধ করে দেয়! প্রতিবেশী নরওয়ে ও ফ্যারো আইল্যান্ডের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী নাচ এখনো টিকে থাকলেও আইসল্যান্ডেরগুলো হারিয়ে গেছে। কার্লসন বলেছেন, তাঁর মনে হয়, দুর্ভিক্ষের পর মানুষ এমনই বিপর্যস্ত ছিল যে তারা নাচ-গানের মানসিকতা হারিয়ে ফেলে।
তবে এত কিছুর পরও তুলনামূলকভাবে কম সময়েই আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছিল দেশটির মানুষ। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যেই জনসংখ্যা অগ্ন্যুৎপাতের আগের সমান, অর্থাৎ ৫০ হাজারে ফিরে যায় এবং তা বাড়তে থাকে।
লাকির ঘটনা অনেক বড় হলেও এর প্রভাব মাত্র দুই দশক স্থায়ী হয়েছিল বলে একে আইসল্যান্ডের ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্ন বলে মানতে চান না অনেকে। কার্লসন তাঁদেরই একজন। তাঁর বক্তব্য, যে ঘটনার প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, ইতিহাসবিদের কাছে সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে হিসাবে তাঁর মতে, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দেশের মৎস্যশিল্পের আধুনিকীকরণই সেই মুহূর্ত। এই প্রক্রিয়াটি মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ আইসল্যান্ডকে ইউরোপের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি থেকে অন্যতম ধনী দেশে পরিণত করে।
আজ, বহুযুগ পরে আবার বৈশ্বিক মন্দার জেরে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে ব্যাংকিং আর পর্যটনের মতো সেবা খাতের ওপর বেশিমাত্রায় নির্ভরশীল আইসল্যান্ডের অর্থনীতি। অনেকেই হয়তো লাকির বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করে আবার সেভাবেই সুদিন ফিরে আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

আইসল্যান্ড
আয়তন: ১০৩০০০ বর্গ কিমি (৩৯৭৬৯ বর্গ মাইল)
জনসংখ্যা: ৩২৩০০০ (জাতিসংঘের ২০০৯-এর হিসাব অনুযায়ী)
প্রধান ধর্ম: খ্রিষ্টধর্ম
প্রধান রপ্তানি: মাছ ও মাছসংক্রান্ত পণ্য, ধাতব পদার্থ
মাথাপিছু আয়: ৪০০৭০ ডলার
তথ্য  বিবিসি

No comments

Powered by Blogger.