মানুষের মুখ-লাঙলের কারিগর by আকমল হোসেন নিপু

‘গরুর কান্ধে লাঙল দিয়া ঠেলতে ঠেলতে/ বাজান চল যাই চল মাঠে লাঙল বাইতে’...। বাংলার কৃষিচিত্রে গরুর কাঁধে লাঙল দিয়ে জমি চষার এই দৃশ্যটি যুগ যুগের। চৈত্র বা বৈশাখ এলে, আকাশ একটু একটু করে রং বদলাতে থাকে। আকাশে ঘনঘোর মেঘ জমে। কখনো আকাশ ফেটে মেঘের গর্জন। ধুলোঝড়, তারপর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামা।


আর সেই বৃষ্টির নবীন জলের পরশ পেয়ে মাটি যখন উর্বরতার সংকেত দেয়, কৃষকেরা তখন নতুন আবাদের সুখে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর জমি চাষের মাধ্যম তো আর কিছু নয়। হালের জোড়া বলদ কিংবা মহিষ। সেই বলদ বা মহিষের কাঁধে বাঁশের জোয়াল, সেই জোয়ালে বাঁধা কাঠের লাঙল। বলদ বা মহিষ সামনে এগিয়ে চলছে। লাঙলের হাতল ধরে বলদ ও মহিষের পিছু পিছু ‘হুট হাট’ করতে করতে এগিয়ে চলেন আবহমান বাংলার কোনো চাষি। কৃষিজমির প্রতিটি পরতে পরতে যার পায়ের ছাপ, লাঙলের ফালে উপড়ে ওঠা মাটির প্রতিটি ভাঁজে ঝরে তার ঘামের ফোঁটা। কিংবা পৌষ বা মাঘ মাসে হাওরাঞ্চলে জমি থেকে যখন বর্ষার পানি নেমে যায়, সেই নরম কাদার খেতে তখন কাঠের লাঙল নিয়ে গরু বা মহিষ দিয়ে হাল চষা—এই বাংলার এটা এক চিরন্তন চাষকাব্য।
এই চেনা চিত্রটা কি এখন খুব বেশি চোখে পড়ে! দেখতে দেখতে কোথায় যেন তার একটা বড় বদল শুরু হয়েছে। কাঠের লাঙলের জায়গা এসে দখল করছে লোহার লাঙল, অর্থাৎ পাওয়ার টিলার। তবে কি অদূর ভবিষ্যতে কোনো একদিন কাঠের লাঙল ঠেলার এই দৃশ্যটি উধাও হয়ে যাবে বাংলার খেত-মাঠ থেকে! একদিন কি কাঠের লাঙল দেখতে যেতে হবে কোনো কৃষি জাদুঘরে! এখন অনেক মাঠেই হঠাৎ করে গরু বা মহিষের হাল দেখা যায় না। ভটভট শব্দে মাটি চষে পাওয়ার টিলার। ফাঁকে ফাঁকে হয়তো কোথাও দেখা যায় গরুর হাল। আগে ভোর হলেই দেখা গেছে, কাঁধে লাঙল নিয়ে গরু বা মহিষ নিয়ে মাঠের দিকে ছুটে চলছেন কৃষক। সেখানে এখন গরু বা মহিষের বদলে অনেক বাড়ি থেকেই পাওয়ার টিলার বেরিয়ে যায় মাঠের দিকে।
তবে কি কাঠের লাঙল আর তেমন একটা দেখা যাবে না! হয়তো আরও অনেক দিন দেখা যাবে। কিন্তু এটা ঠিক, এখন আর কাঠের লাঙলের দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। ভালো নেই লাঙলের কারিগরেরাও। সে রকমই এক আভাস দিলেন কাঠের লাঙল তৈরির একজন কারিগর ইউসুফ মিয়া (৫০)। অনেক বছর ধরে তিনি এই কাঠের লাঙল তৈরি করে বাজারে বিক্রি করছেন। ইউসুফ মিয়ার সঙ্গে দেখা মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের ছয়ছিরির দিঘির পাড়ে চৈত্রসংক্রান্তির মেলায়। তিনি মেলার একপাশে ২০-২৫টি কাঠের তৈরি লাঙল নিয়ে বসে ছিলেন। এখানেও তাঁর শৈল্পিক কাজটি বন্ধ নেই। হাতুড়ি ও বাটালি দিয়ে টুকটুক করে লাঙলের ভাঁজগুলোকে মসৃণ করছিলেন। তাঁর বাড়ি শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোনে। চৈত্র ও বৈশাখ মাসের দু-একটি বারুণী মেলায় তিনি লাঙল বিক্রি করতে যান। তবে ইউসুফ মিয়া জানালেন, তিনি মূলত শ্রীমঙ্গল শহরের পুরান বাজার এলাকায় শনি ও মঙ্গলবার লাঙল নিয়ে বসেন। শুধু তিনিই নন, তাঁর এলাকার এ রকম আরও আট-দশজন আছেন; যাঁরা লাঙল তৈরির সঙ্গে জড়িত। তাঁরাও আসেন লাঙলের হাটে।
তবে মন ভালো নেই লাঙলের কারিগর ইউসুফ মিয়ার। কেমন নিরুত্তাপ স্বরেই বললেন, ‘বাপ-দাদার আমল থাকিই লাঙল বানাই। তবে এখন লাঙল কম চলে। পাওয়ার টিলার লাঙলরে খাইলিছে। এখন কষ্টমষ্ট করি চলা লাগে।’ জানালেন, আগে বলতে বছর কয়েক আগেও প্রতি লাঙলের হাটে ৩০ থেকে ৪০টা লাঙল বিক্রি হতো। এখন প্রতি বাজারে বিক্রি হয় আট থেকে দশটা। কোনো কোনো বাজারবারে আরও কম। এই লাঙল তিনি তৈরি করেন আম ও বনাকজাতীয় গাছের কাঠ থেকে। আগে নিজেদের বাড়ির গাছ থেকেই করতে পারতেন। এখন গাছ কিনতে হয় বিভিন্ন জায়গা থেকে। একটি কাঠের লাঙল বানাতে কাঠ, লোহার ফালসহ আনুষঙ্গিক খরচ পড়ে ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। লাঙল বিক্রি করেন ২৫০ টাকায়। তিনি জানালেন, একটি লাঙল বানাতে দুই-তিন ঘণ্টা বা আরও বেশি সময় লেগে যায়। এত শ্রম ও বিনিয়োগ করে কম বিক্রি হলে পোষাতে পারেন না এই কৃষিযন্ত্রের কারিগর। তবু কিছু করার নেই। তাঁর জীবন ‘লাঙলের সাথে যেন মিশে আছে একসাথে’...। লাঙল তৈরির কাজটি এখন তাঁর পেশা হলেও এটি একটি নেশাও। গোল বা চৌকো এক টুকরো কাঠ যেভাবে ইউসুফ মিয়ার হাতে আদল বদলে একটি লাঙল হয়ে ওঠে, এটা কেবল একজন শিল্পীর হাতেই হতে পারে। আর হয়তো শিল্পীরাই এমন বড় কিছু পাওয়ার আশা না করেই লেগে থাকতে পারেন। যন্ত্রের কাছে হার মানা না মানার এই সময়ে কাঠের লাঙল বানানো আর বিক্রি, এতেই জীবন এখন বাঁধা পড়ে আছে এই কারিগরের।

No comments

Powered by Blogger.