প্রতিক্রিয়া-দোষ লেজের, নাকি মূল শরীরের? by সুশান্ত সিনহা

‘লেজুড়বৃত্তির এই ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ৫ এপ্রিল প্রকাশিত বদিউল আলম মজুমদারের লেখায় তিনি দেশের দুরারোগ্য এই ব্যাধির চিকিৎসা হিসেবে শুধু ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর লেখা পড়ে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর পেতেই এই লেখার চেষ্টা।


প্রথমত, আজকে যে নষ্ট অবস্থা ছাত্ররাজনীতিতে দেখছি, তা কি শুধু ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেই, নাকি মূল দল বা জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও সত্য? শুধু তো ছাত্ররাজনীতিই পথভ্রষ্ট হয়নি, দলীয় মূলধারার রাজনীতিরও অধঃপতন হয়েছে বলেই এর ছাপ পড়েছে ছাত্ররাজনীতিতে। যদিও জনাব মজুমদার মাত্র এক প্যারায় নিজেই উল্লেখ করেছেন, ‘ছাত্ররাজনীতির বর্তমান অবক্ষয়ের জন্য মূলত দায়ী আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর দেউলিয়াপনা’। তাহলে প্রশ্ন আসে, দায়ী কি লেজুড় ছাত্ররাজনীতি, নাকি মূল দলগুলো? দেউলিয়াপনা, লুটপাট ও অবক্ষয়ী রাজনীতির সংস্পর্শে এসে কেউ যদি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে, তবে দোষটা কার? আপনি তো সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন, তাই আপনার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর তো প্রত্যাশা করতেই পারি। যেকোনো প্রাণীর ক্ষেত্রেই লেজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, কিন্তু লেজ একা একা কাজ করতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মাথা বা শরীর থেকে নির্দেশ না পায়। ফলে মূল দলের অবস্থানটি কি গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজন নেই?
আপনি লিখেছেন, ‘ছাত্ররাজনীতির কারণে গণতান্ত্রিক শাসনামলে প্রায় আড়াই শ শিক্ষার্থী বলি হয়েছে।’ আপনার এই তথ্য নিশ্চিয় সত্য এবং তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ১৯৯০ সালের পরে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জামাত-জাতীয় পার্টির সন্ত্রাসী কার্যক্রমে কয়েক হাজার মানুষ খুন হয়েছে; পাবর্ত্য চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা গেছে; বখাটেদের কারণে সিমি, ইলোরার মতো বেশ কয়েকজন মেয়েকে জীবন দিতে হয়েছে; গত দেড় মাসে চট্টগ্রামেই খুন হয়েছে তিনজন শিক্ষার্থী; ঢাকাসহ সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন ১০-১২ জন খুন হচ্ছে। এসবের জন্য তো ছাত্ররাজনীতি দায়ী নয়। সামাজিক মূল্যবোধের ধস আর অবক্ষয় আমাদের এই জায়গায় নিয়ে গেছে। প্রকৃত দায়ী কোনটা, তা সবাইকে জানানো উচিত নয় কি?
দ্বিতীয়ত, অতীতের ছাত্ররাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার রেশ টেনে ধরে আপনি লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করার কথা বলেছেন। অথচ এটাও নির্মম সত্য যে আজকের মতো অতীতেও এসব ছাত্রসংগঠন মূল দলগুলোর সঙ্গে লেজুড় হয়েই কাজ করেছে। তখন তো এমন বদনাম ছাত্রনেতাদের নামে হয়নি। তাহলে প্রশ্ন আসে, কোন জাদুকাঠির বদৌলতে সেদিন ছাত্ররানীতি দেশের আপামর মানুষের জন্য কাজ করতে পেরেছে আর আজ কেনই বা তা কলুষিত? এখন কেন সিট দখলের হানাহানিতে ব্যস্ত হচ্ছে তারা? কারণ এটাই নয় কি যে ক্ষমতালিপ্সার কারণে নব্বই-পরবর্তী প্রতিটি সরকারি দলের লোকজনই দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদের ইমারত গড়েছে? ধ্বংস করেছে ন্যায়-নীতিকে, মূল্যবোধকে গলা টিপে হত্যা করেছে, প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতিকেরা ক্ষুদ্র ও হীন স্বার্থ জায়েজ করতে সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে পুরো সমাজকে।
তৃতীয়ত, আপনি নিজেই বলেছেন শিক্ষকরাজনীতির কারণে শিক্ষার মান নিম্নগামী হওয়ার কথা। সমস্ত নিয়মনীতি পায়ে দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে হলের প্রভোস্ট, হাউস টিউটর—সব পদেই দলীয় ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রশাসন অবস্থান নিতে পারে না—এটাই দুই দশক ধরে দেখে আসছি। এসব ক্ষেত্রেও ছাত্ররাজনীতির কিছু করার আছে কি? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ১৯৯০ সালের পর দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী বেড়েছে কয়েকগুণ। অথচ সেই অনুপাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবং হল ও হোস্টেল বাড়েনি, যে বিষয়টি আপনার লেখায় একটিবারের জন্যও আসেনি।
মূলধারার বাইরের ছাত্রসংগঠনগুলো যখন শিক্ষার দাবি নিয়ে কাজ করছে, তাদের কথা এভাবে বেমালুম চেপে গিয়ে কি অধঃপতিত ধারার ছাত্ররাজনীতির হাতকে শক্তিশালী করছেন না? এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে সুস্থ ধারা ও অসুস্থ ধারাকে স্পষ্টভাবে ছাত্র সমাজসহ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার কি সময় আসেনি? দেশের রাজনীতিতে ভালো মানুষের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে দুর্নীতিপরায়ণ ও অবৈধ সম্পদশালী মানুষের সংখ্যা। তাই অন্ধের মতো উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে কোন ফল পাওয়া যাবে না।
সুশান্ত সিনহা: সাংবাদিক, এটিএন নিউজ।
sinhasmp@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.