হরতালে দিনে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা

হরতাল যারা ডাকে আর যাদের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকা হয়; যারা হরতাল মানে আর যারা মানে না; যারা হরতালে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহায়; এমনকি যারা হরতালের সাতেও না, পাঁচেও না- তারা সবাই একটা কথা স্বীকার করে যে হরতালে ক্ষতি হয় দেশের, দেশের মানুষের। এই ক্ষতি কত?


কাঁটায় কাঁটায় হিসাব কষে বলা না গেলেও বলা যায়, হরতালে ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। এ দেশে যখন যারা বিরোধী দলে থাকে, তখন তারাই সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে হরতাল করে। ক্ষয়ক্ষতির কথা জেনেও অনেক সময় হরতাল ডাকে তারা। বিরোধী দল আবার সরকারে গিয়ে হরতালের ক্ষয়ক্ষতির কথা স্মরণে এনে অঙ্গীকার করে, জীবনে আর কখনোই হরতাল করবে না। কিন্তু সে অঙ্গীকার আর থাকে না। আবার শুরু হয় হরতালের পালা। এ দেশে এত ঘন ঘন হরতাল সত্ত্বেও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেউ কখনো হরতালে সঠিক ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করেনি। আর সব ক্ষতি টাকার অঙ্কে হিসাব করাও কঠিন। তবু কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে হরতালে ক্ষয়ক্ষতির বেশ কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এসব তথ্যের মূল কথাটা হলো, এক দিনের হরতালে মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির ৮০ শতাংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ৮০ শতাংশ টাকার অঙ্কে দাঁড়ায় এক হাজার ৭২৫ কোটি। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, এক দিনের জিডিপির ৮০ শতাংশের ঠিক কতটুকু এক দিনের হরতালে ক্ষতি হয়?
এই প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, হরতালের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে তাঁরা একটা হিসাব করছেন। শিগগির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব হবে। তবে ২০০৫ সালে ইউএনডিপির এক হিসাবের উদ্ধৃতি দিয়ে এ কে আজাদ বলেন, এখন এক দিনের হরতালে ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা হতে পারে।
হিসাবটা আসলেই বেশ জটিল। তবু এভাবে বলা যায়, চলতি বাজারমূল্যে গত অর্থবছরে (২০১০-১১) বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৮৭ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক দিনের জিডিপি দুই হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের ভেতরে প্রতিদিন যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন ও সেবা দেওয়া হচ্ছে, এ আর্থিক মূল্য দুই হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এই জিডিপিতে মোট ১৫টি খাতের উৎপাদন হিসাব করা হয়। খাতগুলোকে আবার বৃহত্তর তিনটি খাতে ভাগ করা যায়। এগুলো হলো- সার্বিক কৃষি, সার্বিক শিল্প ও সার্বিক সেবা। জিডিপিতে এদের অবদান যথাক্রমে ১৯.৯৫ শতাংশ, ২৯.৯৩ ও ৪৯.৭২ শতাংশ। স্বাভাবিক ছুটির দিনে কেবল শিল্প খাতে ম্যানুফ্যাকচারিং আর সেবা খাতে আর্থিক ও শিক্ষা-প্রাতিষ্ঠানিক সেবা বন্ধ থাকে। আর প্রায় সব খাতেই উৎপাদন অব্যাহত থাকে। কিন্তু হরতাল হলে সার্বিক কৃষি (কৃষি, বনজ ও মৎস্য) ছাড়া সব খাতেই উৎপাদন ও সেবা ব্যাহত হয়। বাকি দুটি খাতই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সার্বিক অর্থনীতিতে এ দুই খাতের অবদান দৈনিক এক হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। এটাই এক দিনের জিডিপির প্রায় ৮০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের অধ্যাপক ড. খন্দকার বজলুল হক বলেন, 'হরতাল অর্থনীতির ক্ষতি করে বিপুলভাবে। তবে এ নিয়ে রাজনৈতিকভাবে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া রয়েছে। যারা সরকারে থাকে, তারা মনে করে হরতাল ক্ষতিকর। আর যারা বিরোধী দলে থাকে, তারা মনে করে হরতাল প্রয়োজন। ঐতিহাসিকভাবে হরতালকে সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছে পাকিস্তান আমলেও, এমন কি স্বাধীনতার পর এইচ এম এরশাদের আমলেও। তবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হরতাল খুবই নেতিবাচক। কারণ যেসব দেশে আমরা রপ্তানি করি, সেসব দেশে হরতাল পরিচিত নয়। সেখানে আমাদের ভাবমূর্তি, ব্র্যান্ডিং- সবই ক্ষুণ্ন হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপক, যা টাকার অঙ্কে হিসাব করা সম্ভব না।' তিনি বলেন, হরতালে দোকান খোলা থাকে না, গাড়ি চলে না। মানুষ কেনাবেচা করতে পারে না, কোথাও যেতে পারে না। ব্যাংক খোলা থাকলেও বড় অঙ্কের লেনদেন করা যায় না। পরিবহন সমস্যার কারণে সব জিনিসের দাম বাড়ে।
খন্দকার বজলুল হক বলেন, 'হরতাল অনেকটা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু বিদেশিদের চোখে এটি নেতিবাচক। হরতাল- তা আওয়ামী লীগেরই হোক বা বিএনপিরই হোক, অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকারক। এর শেষ হওয়া উচিত।'
অনুসন্ধানে দেখা যায়, হরতালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে সার্বিক সেবার প্রধান দুই খাত- পরিবহন ও বাণিজ্য। বিশেষ করে পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য এবং সড়ক যোগাযোগ পুরোপুরিই অচল হয়ে যায় হরতালে। ছোট-বড় সব ব্যবসাই বন্ধ থাকে। আকাশ ও রেলপথে যোগাযোগ চললেও দেশের পরিবহন ব্যবস্থা ও জিডিপিতে এ দুই উপখাতের অংশ নগণ্য। হিসাবে দেখা যায়, জিডিপিতে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসার অবদান দৈনিক ৩০৮ কোটি টাকা, আর স্থলপথে পরিবহনের অবদান ১৩৪ কোটি টাকা। হরতালে বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা খাতের সব কর্মকাণ্ড, যার আর্থিক মূল্য প্রতিদিন ৬০ কোটি টাকা। একদিনের হরতালে এ তিনটি সেবা খাত থেকেই ৫০২ কোটি টাকা বঞ্চিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
হরতালে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আরো যেসব খাত তার মধ্যে রয়েছে- শিল্প (ম্যানুফ্যাকচারিং), নির্মাণ, রিয়েল এস্টেট, আর্থিক প্রাতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা, কমিউনিটি ও ব্যক্তিগত সেবা, লোক প্রশাসন, হোটেল-রেস্তরাঁ, পানিপথে পরিবহন ইত্যাদি। জিডিপিতে এসব খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। হরতালে এসব খাতের উৎপাদন ও সেবাও ব্যাহত হয়। স্বাস্থ্যসেবা হরতালের আওতামুক্ত থাকলেও পরিবহন না থাকায় মানুষ সেবা পায় না। রাজনৈতিক দলগুলো রপ্তানিমুখী পোশাক খাতকেও হরতালের বাইরে রাখে, কিন্তু পণ্যবাহী ট্রাক ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামে না বলে এ খাতেও ক্ষতি হয় বিপুল।
ব্যবসায়ীদের হিসাবে, হরতালে কলকারখানা খোলা রাখা হলেও পরিবহন বন্ধ থাকার কারণে উৎপাদন হয় অর্ধেক বা তারও কম। জিডিপিতে শিল্প খাতের দৈনিক অবদান প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। হরতালের দিন যদি অর্ধেক উৎপাদন হয়, তাহলে এ খাতের অবদান নেমে আসে ২০০ কোটি টাকায়।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, 'হরতালে অর্থনীতির ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু নেই। তবে হরতালের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কম্প্রিহেনসিভ কোনো স্টাডি বাংলাদেশে কেউ করেছে বলে আমার জানা নেই। একবার ইউএনডিপি বলেছিল, হরতালে উৎপাদন ক্ষতি হয় দিনে ৫০০ কোটি টাকা। এটি কম্প্রিহেনসিভ কোনো হিসাব নয়। ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে যদি আংশিক ক্ষতিও হয়, তার অঙ্কও কম নয়। হরতালে ট্রেন বন্ধ হয় না, তবে বাস-ট্রাক তো রাস্তায় নামে না। কৃষি খাতে উৎপাদন চললেও পণ্য চলাচল ব্যাহত হয়। শ্রমজীবী মানুষের জীবিকার ক্ষতি হয়। আবার, পরিবহন না চলায় জ্বালানি খরচ বেঁচে যায়, দূষণ কম হয়। সামগ্রিক হিসাবে এ বিষয়গুলোও আসতে পারে। বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও উৎপাদন হিসাব করে হরতালের ক্ষয়ক্ষতির একটি হিসাব দাঁড় করানো সম্ভব। অবশ্য সব কিছুই টাকার অঙ্কে হিসাব করা সহজ নয়।
অর্থনীতিবিদদের কাছেও হরতালের ক্ষয়ক্ষতির কোনো গ্রহণযোগ্য হিসাব নেই। গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের প্রধান ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, তাঁর জানা মতে হরতাল নিয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থনৈতিক গবেষণা নেই। তবে জিডিপিতে খাতওয়ারি অবদানের হিসাবে একটি ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
অর্থনীতিবিদদের গবেষণা না থাকলেও ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীদের কাছে হিসাব রয়েছে। কারণ তাদের বিনিয়োগ রয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য মতে, এক দিনের হরতালে পোশাক খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১০৮ কোটি টাকা।
হরতালে দোকান মালিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আমির হোসেন খান বলেন, হরতালে তাঁদের দৈনিক ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজধানীতেই প্রতিদিন সাড়ে ১২ হাজার বাস ও মিনিবাস বন্ধ রাখতে হয় হরতালের কারণে। এর মধ্যে ঢাকার লোকাল গাড়িই ছয় হাজার। বিভিন্ন টার্মিনালে বন্ধ থাকে বিভিন্ন জেলার আরো বাস-মিনিবাস।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এনায়েত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, হরতালের কারণে সারা দেশে গড়ে প্রতিদিন কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ বাস-মিনিবাস ও ট্রাক চলাচল বন্ধ ছিল দিনের বেলায়। এ কারণে কমপক্ষে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, পোশাক খাত হরতালের আওতামুক্ত। কারখানাগুলোতে উৎপাদন কার্যক্রম চললেও মালামাল পরিবহন বা স্থানান্তর করা যাচ্ছে না। বন্দর থেকে কাঁচামাল কারখানায় আনা যাচ্ছে না। আবার উৎপাদিত পোশাক রপ্তানির জন্য বন্দরেও নেওয়া যাচ্ছে না। সময়মতো শিপমেন্ট করতে না পারলে রপ্তানি করা পোশাক কম দামে বিক্রি করতে হয়। আওতামুক্ত থাকার পরও পোশাক খাতের এত ক্ষতি হলে অন্য খাতগুলোর ক্ষতি যে আরো বেশি, তা সহজেই বোঝা যায়। তিনি বলেন, 'প্রতিদিনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়েই দেশের জিডিপির আকার হিসাব করা হয়। হরতালের কারণে এক দিনেই যেসব কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়, হিসাব করলে দেখা যাবে তার পরিমাণ কয়েক লাখ ডলার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তির সমস্যা তো হয়ই, যার মুখোমুখি আমাদের প্রতিনিয়তই হতে হচ্ছে। এ ছাড়া হরতালের কারণে সামাজিক ক্ষতিও রয়েছে। পরীক্ষা পেছানোর কারণে বাচ্চাদের ওপর যে মানসিক চাপ বাড়ছে, তার আর্থিক মূল্য কিভাবে নির্ধারণ করবেন?

No comments

Powered by Blogger.