নারী দিবসে কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা by ড. নিয়াজ আহম্মেদ

একটি বিশেষ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে আমরা প্রতিবছর জাঁকজমকপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপন করি। শোভাযাত্রা, সমাবেশ, আলোচনা সভা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে উদ্যাপিত এ দিবসটি তাৎপর্য বহন করে। দিবসটি উদ্যাপনের মাধ্যমে আমরা সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোকে নারী উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি প্রণয়নের আহ্বান জানাই।


পাশাপাশি জনসাধারণের মধ্যে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণ ও উন্নয়নে সচেতনতা সৃষ্টিরও চেষ্টা করি। লক্ষ্য একটিই, আর সেটি হলো দেশের নারীসমাজের সর্বজনীন কল্যাণ সাধন। এ কথা সত্য যে দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক নারীকে পেছনে ফেলে রেখে টেকসই উন্নয়ন আশা করা দুরাশা মাত্র। আবার এই অর্ধেক নারীসমাজ প্রতিনিয়ত কোনো না কোনোভাবে বৈষম্য ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে। একমাত্র তাদের উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসার মাধ্যমে আমাদের অগ্রযাত্রা সহজ ও সাবলীল হবে_এটাই স্বাভাবিক।
গত দুই দশকে নারী উন্নয়নে বহুবিধ নীতি, পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো অনেক ক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখেছে। এ সময়ে নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। বেড়েছে কর্মসংস্থানের পরিমাণও। শিশুমৃত্যু ও প্রসূতিমৃত্যু ব্যাপক হারে সংকোচনের ক্ষেত্রে আমরা বেশ সাফল্য অর্জন করেছি। নারীর কাজের ক্ষেত্র এখন নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। নারীরা এখন পুরুষের পাশাপাশি সব ধরনের কর্মে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কোথাও কোথাও মেয়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় বেশি। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে বটে, কিন্তু শারীরিক, সামাজিক ও মানসিক স্বাবলম্বন নারীকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করে তুলেছে। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, এমনকি উচ্চবিত্ত পরিবারেও নারীকে সামাজিক ও মানসিক স্বাবলম্বন অর্জনে কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে যখন জাতিসংঘ বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ বউ পেটানোর দেশ হিসেবে চিহ্নিত করে, তখন সহজেই অনুধাবন করা যায়, আমাদের দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার চিত্রটি কী রকম।
নারীর প্রতি বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার সঙ্গে ইভ টিজিং একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। প্রতিদিন পত্রপত্রিকা খুললে ইভ টিজিংয়ের ঘটনা চোখে পড়ে। সম্প্রতি হিল্লা বিয়েসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ফতোয়া দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যখন নারীরা হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে শিক্ষা-দীক্ষা ও কর্মসংস্থানের দিকে এগিয়ে চলছে, তখন এ ধরনের ঘটনা তাদের নৈতিক অগ্রগতিকে পেছনের দিকে টেনে নেবে_এটাই স্বাভাবিক। আমাদের কষ্ট লাগে, যখন ফতোয়া জারির এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকে আমাদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং সরকারের বেতনভুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষকরা। প্রায় প্রতিটি ঘটনার পেছনেই রয়েছে শক্ত হাত। অথচ এদের দায়িত্ব হলো, ফতোয়াকে প্রতিরোধ করা। আমরা শর্ষের ভেতর ভূত লক্ষ করছি। যিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি, তিনি কিভাবে ফতোয়া জারিতে সম্পৃক্ত হয়ে পরোক্ষভাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হন। আর যিনি মাদ্রাসার শিক্ষক, তিনি তো সরকারি অর্থে নিজের জীবনযাত্রা নির্বাহ করেন। তিনি কি অন্ধ, নাকি অন্ধত্বের ভান করছেন। প্রায় এক দশক আগে হাইকোর্ট ফতোয়া দেওয়াকে বেআইনি ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আজ পর্যন্ত আপিলের শুনানি হয়নি। যার সুযোগ নিচ্ছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীগোষ্ঠী।
আমাদের দেশের নারীরা যেভাবে এবং যত দ্রুত নিজেদের আত্মনির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তত দ্রুত তারা ইভ টিজিংসহ বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। আর এর জন্য মূলত কতগুলো বিষয় দায়ী। নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ ও অধিকার আদায়ের জন্য জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও), বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন এবং মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অন্যতম। প্রতিটি আন্তর্জাতিক সনদে নারী অধিকার, বৈষম্য বিলোপ সাধনের ও উন্নয়নের জন্য লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচির দিকনির্দেশনা রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে নারী উন্নয়নের জন্য জাতীয় নারী উন্নয়ন-নীতি বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মৌলবাদীগোষ্ঠীর চাপের মুখে স্থগিত করা হয়। আমাদের আরো দুর্ভাগ্য, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও জাতীয় নারী উন্নয়ন-নীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারছে না। ফলে নারী উন্নয়নের সঠিক নির্দেশনার অভাবে আমাদের নারীরা পিছিয়ে পড়ছে। যদিও নারীর প্রতি সহিংসতা নিরসনে সরকার আগের ব্যর্থতার জন্য নতুন আইন নিয়ে আসছে, কিন্তু তা বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ সিডও সনদে স্বাক্ষর করলেও তিনটি ধারা অনুমোদন করেনি। ধারাগুলো হলো_২, ১৩(ক) এবং ১৬.১(গ) ও (চ)। যেখানে যথাক্রমে বৈষম্য বিলোপের নীতি ও নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদকালে একই অধিকার ও দায়িত্ব এবং অভিভাবকত্ব, প্রতিপালকত্ব ও পোষ্যসন্তান গ্রহণের ক্ষেত্রে একই অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। সিডও নারী অধিকার-সংবলিত ১৬টি ধারারও অধিকাংশই বাংলাদেশে যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। মুসলিমপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইরান পারিবারিক আইনের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও তুরস্কের মতো দেশও পারিবারিক আইনের মধ্যে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের, আমরা মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র দাবি করেও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছি। সম্প্রতি সরকার স্বল্প বেতনভোগী চাকরিজীবী নারীদের প্রসূতিভাতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। আমরা এটিকে সাধুবাদ জানাই। ভুল নয় যে সরকারের বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে নারীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে, কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতার পরিমাণ কমছে না; বরং দিন দিন বেড়েই চলছে। আমরা চাইব সহিংসতার অবসান, বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং নারীদের মুক্ত, সাহসী ও স্বাধীন পদচারণা। আজ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার_আমরা যেন নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ না করি।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
neayahmed@2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.