ইসলামে সামাজিক শিষ্টাচারের বিধান by মুফতি এনায়েতুল্লাহ

মানুষ সমাজবদ্ধভাবে চলতে পছন্দ করে। সাধারণত কোনো মানুষ একা চলতে পারে না। সমাজবদ্ধভাবে চলতে গেলে মানুষকে সবক্ষেত্রে কিছু সামাজিক নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। এই নিয়মকে ভদ্রতা ও শিষ্টাচার বলা হয়। ইসলাম মানুষকে সমাজে উগ্র ও ভদ্রতা বিবর্জিতপন্থায় চলতে নিষেধ করেছে। কোনো মুসলমানের চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-ব্যবহারে যদি অন্য কেউ কষ্ট পায়, তাহলে সে ব্যক্তি প্রকৃত মুসলমান বলে গণ্য হবে না। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)


তাঁর প্রিয় সাহাবাদের ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন। ভদ্রভাবে চলা সুন্নতও বটে। শিষ্টাচার ও সদ্ব্যবহার প্রসঙ্গে কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, 'নিকটাত্মীয় ও এতিম-মিসকিনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করো।'-সূরা নিসা : ৩৬
এ প্রসঙ্গে হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) (সাহাবাদের মজলিসে) বললেন, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি কিছুতেই ইমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি কিছুতেই ইমানদার নয়, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, সে লোকটি কিছুতেই ইমানদার নয়। সাহাবিদের মধ্য থেকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! (এমন হতভাগা) লোকটি কে? হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, যার অনিষ্ট হতে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।'-বুখারী ও মুসলিম
আরেক হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, এক লোক হজরত রাসূলুল্লাহর (সা.) কাছে এসে নিবেদন করল, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক স্ত্রী লোকটি অধিক নফল নামাজ, অধিক নফল রোজা ও অধিক দান-খয়রাতের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু সে তার প্রতিবেশীদিগকে জিহ্বা দ্বারা কষ্ট দেয়। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে জাহান্নামি। সে আবার আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! অমুক স্ত্রী লোকটি সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, সে নফল নামাজ কম পড়ে, নফল রোজা কম রাখে এবং কম দান-খয়রাত করে। কিন্তু মুখের ভাষা দিয়ে কোনো প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, সে জান্নাতবাসিনী।'-মিশকাত
উপরোক্ত কোরআনের আয়াত ও হাদিস দ্বারা এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও এলাকা নির্বিশেষে সবার সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করাই ইসলামের নির্দেশ। তাদের সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে সাহায্য-সহযোগিতা করা নৈতিক দায়িত্ব। এ ছাড়া সমাজে অশান্তি সৃষ্টিকারী বিষয়াদিসহ কারও মনে কষ্ট হয় ও পরস্পরে মনোমালিন্যের কারণ হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত। বিশেষ করে গর্ব-অহঙ্কার, মিথ্যাচার, গিবত-শেকায়েত ও চোগলখোরি থেকে বিরত থাকা।
একজন মানুষের সব ধরনের ভালো গুণগুলোকে আত্মাভিমান নষ্ট করে দেয়। সাধারণত অহঙ্কারী ব্যক্তি আত্মপূজারি হয়ে থাকে, সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ ও অন্যদের ছোট মনে করে, যা সমাজে ভীষণভাবে ফেতনা সৃষ্টি করে। গর্ব-অহঙ্কার সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, 'আর জমিনের ওপর গর্বভরে চলো না, আল্লাহ কোনো আত্মঅহঙ্কারী দাম্ভিক মানুষকে ভালোবাসেন না।'-সূরা লোকমান : ১৮
অহঙ্কারী ব্যক্তি সম্পর্কে হাদিসে প্রিয়নবী (সা.) কঠোর সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত হারেছা ইবনে ওহাব (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'অহঙ্কারী ও অহঙ্কারের মিথ্যা ভানকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।'-আবু দাউদ
সামাজিক বিভেদ সৃষ্টিকারী অন্য আরেকটি বিষয় হলো পরনিন্দা। পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো ও অন্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করা ইসলামের দৃষ্টিতে মারাত্মক অপরাধ। আমাদের সমাজে পরনিন্দার প্রকোপ এতই বেশি যে, এটা রীতিমতো ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। মানুষ অবচেতনভাবেই পরনিন্দায় লিপ্ত। ইসলামের পরিভাষায়, কারও অনুপস্থিতিতে এমন কোনো দোষের কথা বলা, যা শুনলে সে মনে কষ্ট ও দুঃখ পাবে। তবে হ্যাঁ, তাকে সংশোধনের নিয়তে বলতে হলে তা গোপনে বলবে। এটাই শাশ্বত ইসলামের বিধান। পরনিন্দা সম্পর্কে কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'হে ইমানদার লোকেরা, তোমরা অনেক ধারণা পোষণ হতে বিরত থেকো। কেননা কোনো কোনো ধারণা পাপ হয়ে থাকে। তোমরা একে অপরের গোপনীয় বিষয় খোঁজাখুঁজি করো না। আর একে অন্যের গিবত করো না। তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কি, যে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে? তোমরা নিজেরাই তো এর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে থাকো। আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ খুব বেশি তওবা কবুলকারী এবং দয়াবান।'-সূরা হুজরাত : ১২
ইসলামী শিষ্টাচার মিথ্যাচারকে মারাত্মক অপরাধ বলে বিবেচনা করে। মিথ্যা কেবল ইসলাম ধর্মেই জঘন্য পাপ নয় বরং পৃথিবীর সকল ধর্ম ও নীতিতেই ভয়াবহ এবং জঘন্যতম অপরাধ। ইদানীং তো মানুষ হাসতে হাসতে মিথ্যা বলছে; বাছবিচার তেমন একটা করছে না। মিথ্যা বলা যেন স্বাভাবিক বিষয়। হাসি-ঠাট্টার ছলেও মিথ্যা বলা নিষেধ। মিথ্যাচার সম্পর্কে কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, 'যে মিথ্যাবাদী তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক।'-সূরা আল ইমরান : ৬১
মিথ্যাচার সম্পর্কে হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে, হজরত বাহয ইবনে হাকিম (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, 'ধ্বংস ও বিফলতা সে ব্যক্তির জন্য যে লোকদের হাসাবার উদ্দেশ্যে মিথ্যা কথা বলে। তার জন্য রয়েছে ধ্বংস, তার জন্য রয়েছে অমঙ্গল।'-তিরমিযী
উপরোলিল্গখিত কোরআনের আয়াত ও হাদিসগুলো মূলত মানবজাতিকে সামাজিক শিষ্টাচারের বিভিন্ন দিকই শিক্ষা দিচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে মানুষর প্রভূত কল্যাণ। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে এসব বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই।
muftianaet@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.