রেলের দুরবস্থা :এক কিলোও বাড়েনি পথ by আলতাব হোসেন

স্বল্প খরচের বাহন রেলকে অগ্রাধিকার দিয়ে নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হবে, রেলের আধুনিকায়ন ও সেবা বাড়ানো হবে। এটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের কথা। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সরকারের প্রায় তিন বছরে রেলপথ এক কিলোমিটারও বাড়েনি। নতুন ইঞ্জিন ও কোচ আসেনি। রেলওয়ে আধুনিকায়নের ছোঁয়া পায়নি। উল্টো জনবলের অভাবে ১৩০ স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো ট্রেনই সময় মেনে চলতে পারছে না। প্রতিদিনই কমপক্ষে ১০টি


ট্রেনকে গড়ে ৭ থেকে ১০ ঘণ্টা বিলম্বে চলাচল করতে হচ্ছে। এ সময় রেলের আয় বাড়লেও যাত্রীসেবা কমেছে। জনবল সংকটে গতি পাচ্ছে না রেলওয়ে। প্রায় ২৩ হাজার জনবলের অভাবে খুঁড়িয়ে চলছে যোগাযোগ খাতের জনপ্রিয় এ সংস্থাটি। নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ১২টি
ট্রেনের অনির্ধারিত যাত্রা বাতিল করতে হচ্ছে। মাসে তিন শতাধিক ট্রেনের যাত্রা বাতিলের ঘটনা ঘটছে। রেলপথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন পরিচালনার জন্য স্টেশন রয়েছে ৪৩৫টি। এসব স্টেশনের বিপরীতে স্টেশন মাস্টারের প্রয়োজনীয় পদের সংখ্যা ১ হাজার ১৪৪টি। অনুমোদিত এই পদের মধ্যে বর্তমানে স্টেশন মাস্টার রয়েছেন ৭১৬ জন।
১৮৬২ সালে যাত্রা শুরু হওয়া বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থা এখন অনেকটাই স্থবির। অথচ পৃথিবীর অনেক দেশেই যাত্রীরা আনন্দ ও উন্নত যাত্রীসেবার সুযোগ নিতে বিমানের পরিবর্তে রেল ভ্রমণকে প্রাধান্য দেন। বর্তমান সরকার রেলপথ সংস্কার কর্মসূচির আওতায় রেলওয়েকে প্রথমে আলাদা বিভাগ করে। সম্প্রতি রেলওয়ের জন্য নতুন মন্ত্রণালয় করা হয়েছে। নতুন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে।
১৪ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩২টি নতুন এবং ৫ হাজার ২৯১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০টি সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন করেছে বর্তমান মহাজোট সরকার। তিন বছরে রেলওয়ে খাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৪ প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রায় ৬৯৯৬.৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫২টি দরপত্রের চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। প্রায় তিন বছরে রেলওয়ের ৪২টি প্রকল্পের কোনোটিরই এখনও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের উন্নয়ন শুধু পরিকল্পনাতেই সীমাবদ্ধ। টাকার অভাবে কোনো পরিকল্পনাই যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারছে না সংস্থাটি। পাতাল রেল, মেট্রো রেল ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কথা সরকার বারবার বললেও বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। প্রতি বছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) কমছে রেলের বরাদ্দ।
রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সমকালকে বলেন, বর্তমান সরকার রেলের প্রতি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি মনোযোগী। রেলওয়েকে একটি করপোরেট সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার কাজ চলছে। রেলের পুরনো ইঞ্জিন আর বগি সংকটে রেল চলাচল ব্যাহত হচ্ছে স্বীকার করে মন্ত্রী বলেন, নতুন ইঞ্জিন ও বগি আনা হচ্ছে, বাড়ানো হচ্ছে রেললাইন। সেবার মান বাড়িয়ে রেলের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে। রাজধানীর যানজট দূর করতে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সঙ্গে কমিউটার ট্রেন চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়াও প্রয়োজনে নতুন আইন করে হলেও রেলের বেদখকৃত সম্পত্তি উদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাওয়া ১৩০ স্টেশনের মধ্যে ৩২টি দ্রুত চালু করা হবে। তিনি বলেন, বিশ্বে একমাত্র বাংলাদেশেই রেল লোকসান দিচ্ছে। এর পরিমাণ বছরে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। লোকসান কমানোর ব্যাপারে তিনি চেষ্টা করছেন।
রেলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, রেলওয়েতে বার বার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কারণে রেল দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান নির্বাহীকে ৩ বার রেলওয়ে বোর্ড তৈরি করে চেয়ারম্যান, ৩ বার জিএম এবং সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে 'বাংলাদেশ রেলওয়ে অথরিটি' গঠন করে যোগাযোগমন্ত্রীকে এর চেয়ারম্যান করা হয়। বর্তমানে রেলওয়ে অথরিটিও কার্যকর নয়। অথচ প্রায় ৬০ বছর সময়ের মধ্যে ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। ভারতীয় রেলওয়ে বোর্ডের চেয়ারম্যান মুখ্য সচিব পদমর্যাদার এবং বোর্ডের অন্যান্য ৫ জন মেম্বার সচিব পদমর্যাদার রেলওয়ে কর্মকর্তা ও একজন ফাইন্যান্সিয়াল কমিশনার অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের কর্মকর্তা। ভারতে ৫৬ হাজার কোটি টাকার রেল বাজেট করা হয়।
রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের সমকালকে বলেন, রেলের জন্য একটি আলাদা মন্ত্রণালয় বা বিভাগের দাবি ছিল দীর্ঘদিনের। বর্তমানে এ সমস্যা দূর হওয়ায় রেল আবার এগিয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি। মহাপরিচালক আরও বলেন, রেলওয়েতে নতুন ট্রেন চালু করার একটি বড় বাধা হলো ডাবল লাইন না থাকা। বর্তমান সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডোরকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার জন্য এডিবির অর্থায়নে টঙ্গী-ভৈরববাজার সেকশনে ৬৪ কিলোমিটার ডাবল লাইন, জাইকার অর্থায়নে চিনকী আস্তানা-লাকসাম সেকশনে ৬১ কিলোমিটার ডাবল লাইন এবং ভারতীয় ডলার ক্রেডিট লাইনের বিপরীতে দ্বিতীয় ভৈরব ও দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণের সমীক্ষা এবং বিস্তারিত ডিজাইনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
৭০ শতাংশ ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে : রেলওয়েতে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ মিলিয়ে ২৮২টি ইঞ্জিন রয়েছে। সাধারণত প্রতিটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। এরই মধ্যে ৭০ শতাংশ ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল পার হয়ে গেছে। ঘোষিত আয়ুষ্কালের দ্বিগুণ ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে ৮২ ইঞ্জিনের। ৪০টি ইঞ্জিনের বয়স ৩০-৪০ বছরের মধ্যে। ২০-৩০ বছর বয়সের ইঞ্জিন রয়েছে ৩৫টি। এগুলো প্রায়ই আবার চলন্ত অবস্থায় বিকল হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, রেল দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ দুর্বল ইঞ্জিন। গত এক বছরে সারাদেশের ক্রসিংয়ে প্রায় ৩২০টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছে শতাধিক ব্যক্তি। আহত হয়েছে কয়েকশ'। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারাদেশে ২ হাজার ৩৯২টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ১৭৬টি ক্রসিংয়ের কোনো অনুমোদন নেই। ১ হাজার ২৩১টির অনুমোদন থাকলেও এতে নেই কোনো নিরাপত্তারক্ষী। কাগজে-কলমে ৩৫২টি ক্রসিংয়ে নিরাপত্তারক্ষী থাকার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা নেই।
১৪ হাজার পদ শূন্য : রেলওয়ের বর্তমানে প্রায় ১৪ হাজার পদ খালি রয়েছে। এর মধ্যে কারিগরি বিভাগসহ গুরুত্বপূর্ণ শূন্যপদের সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মোহাম্মদ শাহজাহান জানান, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর পদ রেলের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এসব পদে দীর্ঘদিন ধরে নতুন করে লোক নিয়োগ না হওয়ায় সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি মোখলেসুর রহমান বলেন, দক্ষ লোকবল ও ইঞ্জিন সংকটের কারণে রেলের কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হওয়ার উপক্রম। এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক আবু তাহের বলেন, প্রয়োজনীয় লোকবল নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলেও উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে সম্ভব হচ্ছে না।
তবু যাত্রী ও আয় বাড়ছে : রেলওয়ের হিসাবে বাংলাদেশ রেলের যাত্রী ও আয় দুটিই বাড়ছে। ২০০৮ সালে রেলযাত্রী পরিবহন করে পাঁচ কোটি ৩০ লাখ ৮০ হাজার। ২০১০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় আট কোটি। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ৫৬১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬২০ কোটি টাকা।
৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত :রেলওয়ের ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মানছেন না রেল কর্মকর্তারা। অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মচারীরা। জানা যায়, রেলওয়ের দুটি সংগঠনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বেশ কয়েকটি ডেভেলপার কোম্পানি চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ রেলওয়ের হাজার হাজার একর জমি দখল করে তাতে প্লট ও ফ্ল্যাট নির্মাণ করে বিক্রি করে যাচ্ছে। হিসাব অনুযায়ী, রেলওয়ের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে সারাদেশে ৫০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। দেশব্যাপী রেলের মোট জমির পরিমাণ ৬৩ হাজার ৩৭২ একর। এর মধ্যে অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ২৩ হাজার ৯০০ একর। যার ১২ হাজার ১০০ একরই এখন অবৈধ দখলদারদের দখলে। রেলওয়ের ইজারাযোগ্য জমি বেদখল হয়ে যাওয়ায় প্রতিবছর সরকারের ৫২ কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৩৭১ টাকা ক্ষতি হচ্ছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে জমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের অডিটে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
বর্তমান সরকারের উদ্যোগ :রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব ফজলে কবির সমকালকে বলেন, এ মূহূর্তে অগ্রাধিকার হচ্ছে, রেলের সময়সূচি ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে ফিরিয়ে আনা। তিনি আরও বলেন, নতুন ৬ জেলায় রেলপথ সম্প্রসারণ, নতুন ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহসহ দক্ষ জনবল নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রথমবারের মতো পর্যটন নগরী কক্সবাজারকে রেলওয়ে নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসার কাজ শুরু হয়েছে। আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিকে প্রাধান্য দিয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে হাতে নেওয়া হয়েছে আরও ৭টি প্রকল্প। আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আখাউড়া থেকে আগরতলা এবং খুলনা থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এদিকে রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ ব্রডগেজ রেলওয়ে রুট নেপাল ট্রানজিট ট্রাফিকের জন্য ব্যবহার এবং রাধিকাপুর-বিরল মিটারগেজ রেললাইনকে ব্রডগেজে রূপান্তরের মাধ্যমে নেপাল ট্রানজিট ট্রাফিক এবং ভুটান পর্যন্ত রেলওয়ে ট্রানজিট লিঙ্ক প্রদানের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব কাজে রেলওয়ের প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নতুন আশার সঞ্চার করেছে।

No comments

Powered by Blogger.