প্রত্যাশা ছাপানো অনুষ্ঠান দিয়ে রবীন্দ্র-উৎসব শুরু

বীন্দ্রনাথের গান তো নতুন কিছু নয়। দেড় শ বছরের রবীন্দ্রনাথের গান সোয়া শ বছরেরও বেশি কাল ধরে শুনে আসছে বাঙালি। তবে নতুনত্ব হলো, কবির সার্ধশততম জন্মবর্ষে বাংলাদেশে সহস্রকণ্ঠে গীত হলো তাঁর কালজয়ী গান। প্রত্যাশা ছাপিয়ে যাওয়া আয়োজন বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। উদ্যোগ যেমন বিপুল, শ্রোতার সমাগমও তেমনি বিস্তর। সর্বোপরি পরিকল্পনামতো সুসম্পন্ন করতে পারার গৌরব। গতকাল বৃহস্পতিবার পৌষের শেষ বেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা তিন দিনের এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রসংগীত চর্চার প্রতিষ্ঠান সুরের ধারা প্রকাশ করেছে শ্রুতি গীতবিতান। এতে গীতবিতান-এ অন্তর্ভুক্ত সব গান এবং এর সঙ্গে গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য মায়ার খেলা, শ্যামা, চণ্ডালিকা, চিত্রাঙ্গদা, বাল্মীকি প্রতিভা ও কালমৃগয়া ২২টি ডিভিডিতে ধারণ করা হয়েছে। এর দুই হাজার ২২২টি গান গেয়েছেন বাংলাদেশের প্রবীণ-নবীন প্রায় ৪০০ শিল্পী। শ্রুতি গীতবিতান প্রকাশ উপলক্ষেই আয়োজন করা হয়েছে রবীন্দ্র-উৎসব। এই আয়োজনে সহায়তা করছে প্রথম আলো ও চ্যানেল আই। উৎসবে নাম নিবন্ধন করে দুই হাজার ৫০০ টাকায় শ্রুতি গীতবিতান সংগ্রহ করা যাবে। এ ছাড়া আগ্রহী ব্যক্তিরা তিন হাজার টাকায় এই অনবদ্য সংকলনটি সংগ্রহ করতে পারবেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হলো বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের প্রাঙ্গণে। প্রধান প্রবেশপথের সামনে মঞ্চ। পুরোনো দিনের ইমারতের আদল ফুটিয়ে তোলা। তার সামনে দুই পাশে ১২ ধাপ সিঁড়ি। মাঝখানের চলাচলের পথটির ওপরে কাঁচাপাকা শ্মশ্রুমণ্ডিত কবির বিশালাকার প্রতিকৃতি। তার সামনের উত্তর দিকে প্রাঙ্গণজুড়ে সারিবদ্ধ করে চেয়ার পাতা। বেলা তিনটা থেকে শুরু হয়েছিল আমন্ত্রিত অতিথিদের প্রবেশ। চারটা বাজার ১০ মিনিট আগে সুশৃঙ্খল লাইন করে শিল্পীরা এলেন মঞ্চে। কয়েক দিন ধরেই গানের সঙ্গে মহড়া হচ্ছিল সহস্র শিল্পীর মঞ্চে ওঠানামা ও অবস্থান নেওয়ার বিষয়ে। সে অনুসারেই যে যাঁর মতো দাঁড়িয়ে গেলেন নির্দিষ্ট জায়গায়। আট মিনিটের মতো সময় লাগল তাতে। অনুষ্ঠান শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল চারটা। মৃদু সুরে যন্ত্রসংগীত বাজছিল। অপেক্ষা তখন প্রধানমন্ত্রীর জন্য। অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হলো না। তিনিও এলেন প্রায় যথাসময়েই, চারটা দশে। আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর আগমনের সঙ্গে সঙ্গেই জাতীয় সংগীত দিয়ে শুরু হবে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। সেই মতো প্রধানমন্ত্রী আসন গ্রহণ করার পরপরই শুরু হলো জাতীয় সংগীত। মঞ্চের হাজার শিল্পী তো গাইলেনই। আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গলা মেলালেন শ্রোতারাও, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...’ সহস্র নয়, সহস্রাধিক কণ্ঠের সুরের অনুরণনে বাঙ্ময় হলো শীত-বিকেলের মায়া।
মূল মঞ্চের সামনেই ছোট একটি বক্তৃতার মঞ্চ। সেখানে সুরের ধারার অধ্যক্ষ শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা শ্রোতাদের স্বাগত জানিয়ে বললেন, কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যই শ্রুতি গীতবিতান প্রকাশের উদ্যোগ। উৎসব উদ্যাপন পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, অনেক দিনের চর্চার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রসংগীতকে শিল্পীরা অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছেন। তবে অখণ্ডভাবে তার রূপ তুলে ধরতে সুরের ধারার এই সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এরপর তিনি শ্রুতি গীতবিতান-এর ডিজিটাল উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ জানান নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে।
ল্যাপটপে ক্লিক করে শ্রুতি গীতবিতান-এর উদ্বোধন করে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গানের চর্চা অনেকই হয়েছে। তবে তাঁর গান নিয়ে যে এমন একটি কাজ করা যায়, তা আমার মাথায় ঢোকেনি।’ তিনি এ জন্য উদ্যোক্তাদের ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথের গানের যে ভাবনার রূপ রয়েছে, শ্রুতি গীতবিতান-এর মধ্য দিয়ে তা সবার হাতে পৌঁছাবে। কথায় যা বলা যায় না, তা সুরের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব। সুর স্মৃতিতে থেকে যায়। বাংলাদেশের সব অঞ্চলের শিল্পীরা এই সুরে কণ্ঠ দিয়েছেন। এর চেয়ে বড় অনুষ্ঠান আর হয়েছে বলে মনে হয় না।’
সবাই খুব অল্প কথায় তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী উৎসবের উদ্বোধন করে বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর গানটিকেই আমাদের জাতীয় সংগীত হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বসভায় স্থান করে দিয়েছেন, তেমনি জাতির জনকের নেতৃত্বেই বাঙালি আত্মপরিচয় নিয়ে বিশ্বের দরবারে স্থান করে নিয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ ২৯ ডিসেম্বর একটি বিশেষ দিন। তিন বছর আগে এই দিনেই আপনারা ভোট দিয়ে আমাদের নির্বাচিত করেছিলেন।’ এ জন্য সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সে কারণেই আজ এখানে উন্মুক্ত পরিবেশে রবীন্দ্রসংগীত উৎসব করা সম্ভব হচ্ছে।’ রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা পুনরুল্লেখ করে তিনি ‘আমি পথিক পথ আমার সাথী...’ কবিতাটির কয়েক ছত্র আবৃত্তি করে শ্রোতাদের বলেন, ‘আমি বক্তৃতা দিতে নয়, গান শুনতে এসেছি। চলুন, সবাই মিলে গান শুনি।’
এরপর আর কথা চলে না। মঞ্চে চলে এলেন সংগীতপরিচালক দেবজ্যোতি মিশ্র ও মাইক্রোফোন হাতে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। দেবজ্যোতি হাতের ইশারা দিতেই সরব হলো প্রধান মঞ্চ। পাশ্চাত্য যন্ত্রানুষঙ্গের সিম্ফনি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে হাজার কণ্ঠে উঠল সুর ‘প্রথম দিনের উদয় দিগঙ্গনে’। পরের গানগুলো ছিল, ‘কান্না হাসির-দোল-দোলানো’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘প্রথম আদি তব শক্তি’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’, ‘আকাশ ভরা সূর্য-তারা’, ‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে’। এ পর্বে গানের পালা শেষ হয়েছিল ‘ওই মহামানব আসে’ পরিবেশনা দিয়ে।
এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের মিল্কিওয়েতে উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত প্রদর্শনী ঘুরে দেখেন। সন্ধ্যার পর উৎসব ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। এ পর্বে ছিল উদ্বোধনী অধিবেশন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা। অনুষ্ঠানে একক সংগীত পরিবেশন করেন ফাহমিদা খাতুন, অদিতি মহসিন, অনিরুদ্ধ সেনগুপ্ত, মহুয়া মঞ্জরী সুনন্দা, প্রতীক এন্দ ও শ্রীকান্ত আচার্য। আবৃত্তি করেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। রাতে হল অব ফেমে ছিল ভারতের নতুন জলপাইগুড়ির দল ইমনের পরিবেশনায় নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা।

No comments

Powered by Blogger.