গ্যাস ও বিদ্যুৎ সঙ্কটে বিনিয়োগ থমকে দাঁড়িয়েছেঃ অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে লাভ হবে না।

বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। তাই বিনিয়োগ নিশ্চিত করা যে কোনো সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য যেসব বিষয়ে নিশ্চয়তা অপরিহার্য তার মধ্যে জ্বালানি অন্যতম। জ্বালানি অর্থাত্ গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত না হলে কেউই বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবেন না। বর্তমানে বিনিয়োগ পরিস্থিতির থমকে থাকা অবস্থার এটা একটা বড় কারণ।
লোডশেডিংয়ের নিয়মিত উপস্থিতি প্রমাণ করে দেশের বর্তমান জ্বালানি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। জ্বালানির এই ঘাটতি দূর না করে বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টা ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার শামিল। ক্ষমতাসীনদের মুখে নানা কথা শোনা গেলেও দেশের জ্বালানি পরিস্থিতি উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। ফলে বিনিয়োগ বৃদ্ধির সব আয়োজন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) ৫ম বাংলাদেশ নিট এক্সিবিশন উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বিষয়টি নতুন করে সামনে উঠে এসেছে। সেমিনারে বাংলাদেশের তৈরি ও নিট পোশাক খাতের জন্য আগামীতে কঠিন সময়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা। বিশেষ করে বিদ্যুত্ ও জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি গোটা শিল্প খাতকেই নাজুক করে তুলেছে। যে বর্তমান বিদ্যুত্ চাহিদা পূরণই সম্ভব হচ্ছে না বলে উদ্যোক্তাদের জেনারেটর চালাতে হচ্ছে সেখানে ভবিষ্যত্ নিয়ে আর কী বলার আছে! জেনারেটরে উত্পাদিত বিদ্যুত্ ব্যবহারের ফলে উত্পাদন খরচ বেড়ে গেলেও করার কিছু নেই। এমনিতেই বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক ও নিট পোশাক খাত চরম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে। যেখানে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে বিদ্যমান জ্বালানি সমস্যা পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে। জ্বালানিসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া সুষ্ঠু সস্তা শ্রম দিয়ে বিশ্ববাজার ধরে রাখা যে সম্ভব নয় সেটা বুঝতে তেমন বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিট পোশাক রফতানিতে এক নম্বর স্থান দখল করেছে চীন। তারা একাই ২৮.৫৮ শতাংশ চাহিদা পূরণ করছে। দ্বিতীয় স্থানে আছে ভিয়েতনাম। আর ২.৫২ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম স্থানে নেমে এসেছে। এ অবস্থায় রফতানি খাতের জন্য অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি জ্বালানি সমস্যার সমাধানের অগ্রাধিকার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। সেমিনারে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা তার ভাষণে গ্যাস ও বিদ্যুত্ খাত নিয়ে কোনো রকম আশার কথা শোনাতে পারেননি। বিষয়টি সবার জন্যই হতাশাজনক। বিকেএমইএর আমন্ত্রণে যে অর্ধ শতাধিক বিদেশি বিনিয়োগকারী বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তারাও বিনিয়োগ পরিবেশের সঙ্গে গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহে নিশ্চয়তা চেয়েছেন। জাপানের বড় একটি শিল্প গ্রুপের ৭ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়েও সংশয় সৃষ্টি হয়েছে জ্বালানির অনিশ্চয়তার কারণে। তাদের শর্ত হচ্ছে বিনিয়োগ চুক্তির ১৭ মাস পর থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এর নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারছে না। দেশের উত্পাদিত বিদ্যুতের ৯০ শতাংশই গ্যাসভিত্তিক। গ্যাসের অভাবে এগুলোই ঠিকমত উত্পাদনে যেতে পারছে না। ফলে দীর্ঘদিনের বিদ্যুত্ সঙ্কট নিয়েই হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। নতুন করে গ্যাস ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তা অসম্ভব কথা।
দেশের জ্বালানি পরিস্থিতির এই চিত্র খুবই হতাশাজনক, সন্দেহ নেই। বিগত সরকারের মতো বর্তমান সরকারও এ ক্ষেত্রে কার্যকর কিছুই করেনি। নানা রকম উদ্যোগ-আয়োজনের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে কী হচ্ছে তার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি? দেশের শিল্পখাত, বিশেষ করে রফতানিমুখী শিল্পের জন্য এটা যে কঠিন তাতে সন্দেহ নেই। তবে অন্যান্য বিষয়ে সময় ও মনোযোগ দেয়ার চেয়ে সরকার যদি গ্যাস-বিদ্যুতের মতো মৌলিক বিষয়ে গুরুত্ব দেয়, তবে আখেরে ভালো হবে বলেই সবার ধারণা। শুধু মুখের কথায় যে বিনিয়োগ করতে কেউ এগিয়ে আসবেন না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেখানে দেশি বিনিয়োগই থমকে দাঁড়িয়েছে, সেখানে অবস্থা অপরিবর্তিত রেখে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা অন্ব্দকারে ঢিল ছোঁড়ার মতোই। এভাবে বেশিদিন টিকে থাকা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.