আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৫৬)-আজও মনে পড়ে by আলী যাকের

য়েক দিন সময় লাগল একজন চাকরিজীবী হিসেবে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিচয়ে নিজের শহরে থিতু হতে। ইতিমধ্যে অফিস করতে শুরু করে দিয়েছি। আমাদের অফিস ছিল তখন মতিঝিলে। তৎকালীন পিআইএর অফিসের পাশে। প্রয়াত কুতুবুদ্দিন চৌধুরী, যাকে আমরা সবাই কুতুব ভাই বলে সম্বোধন করতাম, তখন এনায়েত করিমের কাছে তাঁর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই মিটিংগুলোতে আমায় উপস্থিত থাকতে হতো, যাতে করে আমি বুঝতে পারি ইস্ট এশিয়াটিক নামের কম্পানিটিকে


চালানোর জন্য আমার দায়িত্ব কী হবে। কাজের ধরন আমার আগে থেকেই শেখা ছিল, কিন্তু উচ্চতর পদের এই দায়িত্ব বুঝে নিতে দুই-চার দিন সময় নিলাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিজ্ঞাপনের কাজ করা দুরূহ ব্যাপার ছিল। কেননা আমরা সাধারণভাবে যেমন জানি, বিজ্ঞাপন কেবল ভোগ্যপণ্যের বিক্রয়ের জন্য করা হয়ে থাকে। সে সময় সব ভোগ্যপণ্য আসত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। এগুলো তৈরিও হতো সেখানে এবং বাজারজাতকরণের বিষয়টিও বিভিন্ন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। ফলে বেশির ভাগ বিজ্ঞাপন করাচি থেকেই তৈরি হয়ে আসত। আমরা কেবল বাংলা রূপান্তর করে সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করতাম। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তখনো টেলিভিশন দর্শকের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত ছিল এবং অনুষ্ঠান প্রচার হতো সাদা-কালোয়। অতএব বেশির ভাগ বিজ্ঞাপনই পত্রপত্রিকায় ছাপা হতো। কিছু যেত হোর্ডিং সাইনে, যাকে আজকাল বিলবোর্ড বলা হয়ে থাকে। তখন সবচেয়ে বহুল প্রচারিত দৈনিক ছিল ইত্তেফাক এবং তার পরই সাপ্তাহিক চিত্রালী। চিত্রালী ছিল বিনোদন সাপ্তাহিক, কিন্তু এর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে অনেক বিখ্যাত লোক জড়িত ছিলেন লেখক এবং প্রতিবেদক হিসেবে। সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ সম্পাদিত এই বিনোদনপত্রে কে না কাজ করেছেন? সৈয়দ শামসুল হক, আহমাদুজ্জামান চৌধুরী, আসাদুজ্জামান নূর, ছড়াকার আখতারুজ্জামান প্রমুখ প্রখ্যাত লেখক, বুদ্ধিজীবীরা। হয়তো অনেকের নাম বাদ পড়ে গেল। কেননা, সেই সময়কার স্মৃতি ধূসর হয়ে এসেছে। নামগুলো মনে পড়ছে না। তবে একটি কথা অনস্বীকার্য যে এস এম পারভেজ, আমাদের পারভেজ ভাই, তাঁর অকৃত্রিম স্নেহ, ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধায় প্রত্যেকের মন জয় করে ফেলতেন অতিসহজেই। ওই সময় ইংরেজি কাগজের মধ্যে ছিল মর্নিং নিউজ আর পাকিস্তান অবজারভার। এগুলোর মধ্যে প্রায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলত। মর্নিং নিউজ ছিল সরকারি মালিকানাধীন পত্রিকা, আর পাকিস্তান অবজারভার ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন। এই পত্রিকার স্বত্বাধিকারী ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেব একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন, জনপ্রতিনিধি ছিলেন এবং যদিও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, আদিতে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি মানুষের ধ্বজাধারী। অতএব প্রচারসংখ্যার দিক দিয়ে অবজারভার অচিরেই এক নম্বর ইংরেজি দৈনিকে পরিণত হয়। একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী হিসেবে পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে আমাদের সখ্য গড়ে তুলতে হতো। ওই সময় অবজারভারের আবদুস সালাম, ওই পত্রিকার তরুণ বার্তা সম্পাদক এবিএম মূসা, ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়া এবং মর্নিং নিউজের দাপুটে সাংবাদিকদের সঙ্গে ভালোই একটা সখ্য গড়ে ওঠে। অবজারভার হাউসে আমার পরিচয় ঘটে আবদুল গনি হাজারীর সঙ্গে। কবি আবদুল গনি হাজারী। আজও মনে পড়ে তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা 'কতিপয় আমলার স্ত্রী'। আমি যখন হাজারী ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হই তখন তিনি অবজারভার গ্রুপের একটি অত্যাধুনিক মুদ্রণশিল্প প্রতিষ্ঠানের নির্মাণের ব্যাপারে জড়িত ছিলেন। তিনি আমাকে অশেষ স্নেহ করতেন। প্রসঙ্গত, দৈনিক সংবাদের নামটি না উল্লেখ করলে আমার এ অধ্যায়ের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সংবাদের জহুর আহমেদ চৌধুরী অত্যন্ত রসিক মানুষ ছিলেন, কিন্তু কলমটি ছিল ক্ষুরধার। তার 'দরবার-ই-জহুর' শিরোনামে উপসম্পাদকীয়গুলো পরবর্তী সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। সেখানেই পরিচয় বজলু ভাই, প্রয়াত বজলুর রহমান এবং শহীদ সাবেরের সঙ্গে। এঁরাও আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রে একেবারেই কিছু বিজ্ঞাপন যে হতো না তা নয়। দুটি বিজ্ঞাপনের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। একটি ঢাকা ডায়িংয়ের বিভিন্ন সামগ্রীর বিজ্ঞাপন, যেমন_টেরি টাওয়েল, বেড শিট, পিলো কেসেস ইত্যাদি, যা বিজ্ঞাপিত হয় স্থিরচিত্রের মাধ্যমে। আরেকটি আরো পরে, ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেডের একটি সাদাকালো বিজ্ঞাপনচিত্র। সেই সময় কাজ করতে গিয়ে যখন দেখলাম যে বিজ্ঞাপন করার মতো পণ্যের অভাব তো এখানে ছিলই, যাও বা ছিল, প্রতিযোগিতামূলক বাজারের অভাবে সেগুলো দোকানে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি হয়ে যেত। অতএব বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন পড়ত না। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে আমরা অভিনব কিছু কাজ করেছিলাম। যেমন_আমাদের কিছু অত্যাধুনিক পাটকল, যাদের প্রস্তুতকৃত সামগ্রী বিশ্বের বাজারে বিক্রি হতো, তাদের আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম, জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান সম্বন্ধে জনসাধারণকে অবহিত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। তারা আমাদের এই যুক্তি মেনে নিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন বহুল প্রচারিত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে আগ্রহী হয়েছিল। আমরা এই পাটকলগুলো, যেমন_পিপলস্্ জুট মিলস, ক্রিসেন্ট জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজ, এদের প্রত্যেকটিকে একেকটি স্বতন্ত্র ব্র্যান্ড হিসেবে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আজকে জানি যে এই বিজ্ঞাপনকে করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি অথবা ব্যবসায়ীর সামাজিক দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমরা এমনকি বার্মা ইস্টার্নের মতো জ্বালানি মার্কেটিং কম্পানিকেও একটি ব্র্যান্ডে পরিণত করি। লক্ষ করা সম্ভব হবে যে এই বি. ই. এস্সো, পাকিস্তান ন্যাশনাল অয়েলস্_এরা কিন্তু সমমানের জ্বালানি বিক্রয় করত। তফাতটা হতে পারত সেবায়। আমরা বার্মা ইস্টার্নকে যে ব্র্যান্ড করেছিলাম, তাদের প্রধান অঙ্গীকার ছিল তেলের পাম্পগুলোতে ক্রেতাসাধারণকে আরো যত্নশীল সেবা প্রদান করা। এই ক্যাম্পেইনটি সেই সময় আলোড়ন সৃষ্টি করে।
(চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.