বহে কাল নিরবধি-আফগানিস্তান : পথ এখনো বন্ধুর by এম আবদুল হাফিজ

ফগানিস্তানে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক সামরিক কর্তৃত্বের পেশাদারি আশাবাদের সঙ্গে রাজনৈতিক বাস্তবতার মিল থাকতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন_বিশেষ করে এখন যখন আগামী দুই বছরে দেশটি একটি পরিবর্তনের ধারার মধ্যে চলমান থাকবে, ২০১৪ সালে যার সমাপ্তি ঘটবে। সম্প্রতি আইসাফের ((ISAF)) শীর্ষ ব্যক্তিরা এ ব্যাপারে তাঁদের দৃঢ় আত্মবিশ্বাস প্রকাশ করেছেন, যদিও তা তাঁদের সামরিক নৈপুণ্যেরই অংশ। আইসাফের কমান্ডার জেনারেল জন অ্যালেন


এবং আফগানিস্তানে ন্যাটোর উচ্চপদস্থ বেসামরিক প্রতিনিধি স্যার সাইমন গাস্কে এখনই নিশ্চিত করতে হবে, তাঁদের পদক্ষেপ ঠিক এবং তা কার্যকরী হবে।
অবশ্য এটি স্বতন্ত্র বিষয় যে তাঁদের আত্মবিশ্বাস আফগানিস্তানে অনেক জাতিগোষ্ঠীর মেজাজের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে পারবে কি না। তবে তা রাখতে পারা আইসাফ এবং আফগানদের পক্ষে আগামী দুই বছরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ওটাই বর্তমান কর্তৃত্ব থেকে আফগান নিয়ন্ত্রিত সরকারের অধীনে অবস্থান্তরপ্রাপ্তির (trasition) সময়। ২০১৪ সালেই আইসাফের ম্যান্ডেট সমাপ্ত হবে এবং যদি কোনো নতুন আন্তর্জাতিক তদারকি সংস্থার বর্তমান ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স ফোর্সের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার প্রয়োজন থাকে, তবে তা হতে হবে একটি নতুন চুক্তির অধীনে এবং আফগান সরকারের সঙ্গে অথবা ন্যাটোর নতুন ছত্রচ্ছায়ায়।
২০১৪ সালে আফগানিস্তানে সারা দেশের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচনে নতুন প্রেসিডেন্টও আসবেন এবং সেই নির্বাচনে বর্তমান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের অংশগ্রহণের যোগ্যতা থাকবে না। সে কারণে ওই নির্বাচনটি হবে নতুন আফগান সরকার, সরকারব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট নতুন ইনস্টিটিউশনগুলোর স্থায়িত্বের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা হবে, যদি নতুন প্রেসিডেন্ট ও প্রশাসন উদ্ভূত পরিবর্তনকে ধীরস্থিরভাবে গ্রহণ করে। আফগান সরকারের জন্য তখন চ্যালেঞ্জ যেটা হবে তা হলো, তার ভবিষ্যতে বিশ্বাস এবং সমরশক্তির ওপর অপেক্ষাকৃত কম ঝোঁক এবং সেই সঙ্গে আফগান সমাজ গঠন ও বিন্যাসে অধিক মনোনিবেশ। যদিও এ মুহূর্তের খবর অবিশ্রান্ত লড়াই, যা চলছে আইসাফ ও তার মিত্র এবং তালেবানসহ আফগান বিদ্রোহীদের মধ্যে।
এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে সাইমন গাসের উচ্চারিত একটি দীর্ঘমেয়াদি আশাবাদের কথা শুনতে ভালো লাগারই কথা_বিশেষ করে যখন তিনি একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তানের কথা বলেন, যা ধ্বংস ও অস্থিতিশীলতার পরিবর্তে এশিয়া ও এতদঞ্চলের জন্য অবদান রাখতে পারে। দেশটির ভূগর্ভস্থ সম্পদ, যাতে রয়েছে বহু ধরনের ধাতব সম্পদ_যার সংগ্রহ দীর্ঘ অস্থিতিশীলতার জন্য বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তা দেশ ও অঞ্চলের জন্য সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। আফগানিস্তানে যে পরিমাণ তাম্র এবং বিরল মৃত্তিকার ভাণ্ডার রয়েছে, মার্কিনিদের অনুমানে তার মূল্য হবে এক ট্রিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ। আফগানদের ধারণায় এই অনুদ্ঘাটিত সম্পদ এরও অধিক মূল্যের হবে। এ ছাড়া এশিয়ার একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আফগানিস্তানের সুন্দর পরিপাটি বাণিজ্যপথ রয়েছে মধ্য এশিয়া, আরব উপসাগরীয় দেশগুলো, ইরান ও পাকিস্তানের সঙ্গে_যা এক নতুন 'সিল্ট রুট'রূপে পরিগণিত হতে পারে। ফলে বলা বাহুল্য, তা হবে একটি অর্থনৈতিক গুণনিয়ক (Economic multiplier)। শুধু এতেই প্রমাণিত হয়, এই বিধ্বস্ত দেশটির সম্ভাবনার বিস্তৃতি কতখানি। আফগানিস্তানের তৃতীয় প্রধান সম্পদ দেশটির ধর্মীয় উগ্রতাকে সংযত করার ক্ষমতা, যার প্রভাব পুরো অঞ্চলের ওপর পড়তে বাধ্য। সাইমন গাসের উক্তি অনুযায়ী_আফগানিস্তান সমগ্র অঞ্চলের জন্য স্থিতিশীলতার শক্তি প্রমাণিত হতে পারে। গাস আরো উল্লেখ করেন যে তালেবানরা কিছুটা উদ্ভটভাবে আফগানিস্তানের সহনশীল এবং অসদৃশ ইসলামী ঐতিহ্যের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তালেবানদের তিনি (গাস) খুব একটা ধর্মীয় প্রণোদনার শক্তি মনে করেন না। প্রমাণস্বরূপ তিনি এক সাম্প্রতিক নির্বাচনের উল্লেখ করেন, যেখানে মাত্র ১০ শতাংশ তালেবান এতে যোগ দেওয়ার কারণ হিসেবে ধর্মের উল্লেখ করে। অন্যদের জন্য কারণ হিসেবে দেখা যায়, রক্ষণশীলতা, দারিদ্র্য এবং ক্ষমতার লোভ। এ ছাড়া অনেকের জন্য রয়েছে তালেবানদের বিশাল সুসংগঠিত অপরাধ ও ড্রাগ নেটওয়ার্কের আকর্ষণ।
জেনারেল অ্যালেন আফগান জনসংখ্যার একটি ইন্টারেস্টিং এজ প্রোফাইল তৈরি করেছেন। এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মতো বিশাল এক তরুণ সমাজ দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং পরিণত বয়স্কদের মধ্যে স্থান করে নিচ্ছে। এই হঠাৎ বেড়ে ওঠা তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেটবান্ধব_যেমনটা এখন সারা পৃথিবীরই বাস্তবতা। এই প্রজন্মের সদস্যরা তাই মা-বাবার চেয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি সম্বন্ধে অনেক বেশি সচেতন। তারা শিক্ষা গ্রহণে ক্ষুধার্ত, দৃষ্টিভঙ্গিতে সেক্যুলার_যদিও মুসলমান হওয়ার জন্য অত্যন্ত গর্বিত। জেনারেল অ্যালেনের কথায় তিনি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এই প্রজন্মের প্রভাব অন্তত আগামী দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে চূড়ান্ত ফ্যাক্টর মনে করেন। এদের প্রবণতা এবং পছন্দ-অপছন্দই ভবিষ্যতের আফগানিস্তানকে পরিচালিত করবে।
কিন্তু এ কথা ভাবা সত্যিই কঠিন যে আইসাফ (ISAF) এবং কারজাই সরকার_আজকের আফগানিস্তানের কারজাই সরকার অগ্রসর হবে দেশটির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরিকল্পিত এক উজ্জ্বল গন্তব্যের দিকে। এ জন্য যে বস্তুটির অভাব, তা হলো একটি আফগান সরকার, যা নাকি সুশাসন ও সমাজ বদলের লক্ষ্য অর্জনের বোঝা স্কন্ধে তুলে নিয়ে এই বিশাল ও মহৎ লক্ষ্য অর্জনে ব্রতী হবে। কিন্তু সাইমন গাস এবং জেনারেল অ্যালেন_উভয়েই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটতে দেখছেন। তাঁরা বলেছেন, তিন হাজার সাবেক তালেবানের কথা, যারা তাদের সংগঠন ত্যাগ করে সরকারের পুনর্গঠন কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছে।
অ্যালেন আরো বলেন, এ ছাড়া আরো অনেক তালেবান পূর্বাপর বিচার ছাড়াই তাদের লড়াইয়ের ফ্রন্ট ছেড়েছে এবং সম্ভবত ঘরে ফিরেছে। তবে এরা কিন্তু সরকারের সঙ্গে পরবর্তী কোনো কর্মসূচিতে নিবন্ধিত হয়নি। সন্দেহ নেই, আইসাফ ও ন্যাটো কর্মকর্তারা যেসব সামাজিক ও ধর্মীয় প্রবণতা আফগানিস্তানে বিরাজ করছে বলে উল্লেখ করেছেন, সেগুলো সেখানে বিদ্যমান। এই সমস্যাগুলো দেশটিতে বিরাজ করা সেখানকার মূল সমস্যা নয়। আসলে এ সবই ঘটে দৃষ্টির অন্তরালে। আসলে সমস্যা হলো, সেগুলোকে দৃষ্টিসীমার মধ্যে এনে সরাসরি সমস্যার মোকাবিলা করা। অতঃপর একপর্যায়ে আফগান রাজনীতিতে সেগুলোকে সামনে রেখেই আফগান সমাজের নেতৃত্ব মুঠোয় আনতে পারাই বিজয়ের প্রথম ধাপ।
দেশময় অব্যাহত যুদ্ধ এবং তালেবানদের দীর্ঘ প্রসারিত হাত প্রমাণ করে, আফগানিস্তানে তা ঘটার আগে দেশটিকে আরো কত পথ পাড়ি দিতে হবে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.