অরুণ বরণ নবারুণ by কে জি মোস্তফা

নিয়মের ফাঁসে কাজ আটকে থাকবে এটা আমার পছন্দ নয়। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, চাইলে আইন মেনেও স্বাধীনভাবে কাজ করা যায়, হয়তো একটু বেশি খাটতে হয়। ছিলাম সাংবাদিক, দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার। দায়িত্ব পেলাম সম্পাদকের। সাল ১৯৭৬। ডিফাঙ্কট নিউজ পেপারের উদ্বৃত্ত সাংবাদিক হিসেবে নিয়োগ পেলাম তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা বিভাগে। শুরুতেই শিশু-কিশোর ‘মাসিক নবারুণ’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব।
ঐতিহ্যবাহী পত্রিকাটি দীর্ঘদিন ধরে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়ে আসছে। সর্বশেষ সম্পাদক ছিলেন সুসাহিত্যিক কাজী আফসার উদ্দীন আহমদ। তার মৃত্যুতে সম্পাদকের পদটি শূন্য। এ যাবত একজন সাব-এডিটরের তত্ত্বাবধানে পত্রিকাটি ‘থোড় বড়ি খাড়া’ অবস্থায় অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। সম্পাদকের দফতর—প্রশস্ত রুম, গদিআঁটা সুখাসন, বিরাট টেবিল, টেলিফোন, আলমিরা, সর্বতোভাবে সুসজ্জিত। দরজায় ভারি পর্দা, ওপারে বসা পিয়ন—স্লকুমের অপেক্ষায়।
কথায় বলে ‘ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার।’ আমার অবস্থা অনেকটা তথৈবচ। দৈনিক পত্রিকায় রাত ১০/১১টায় রিপোর্ট জমা দিয়ে বাসায় ফিরতাম, পরদিন ভোরে পরিপাটি তরতাজা পত্রিকাটি হাতে এসে পৌঁছত। মেকআপ বা মুদ্রণ, ‘টেকনিক্যাল নো-হাউ’ জানার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু এখন তা জানা জরুরি হয়ে পড়ল। সম্পাদকের নির্দেশ বা পরামর্শের জন্য সহকারীরা থাকে অপেক্ষায়। পত্রিকার সাইজ, হেডিং, পয়েন্ট, কলাম, নিউজপ্রিন্ট, হোয়াইট প্রিন্ট, আর্ট পেপার, ছবির সাইজ, ব্লক তৈরি ইত্যাদি।
চালু ছকের সম্পূর্ণ বাইরে এসে নিজস্বতার প্রত্যয়ে অগত্যা নিজের অজ্ঞতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করলাম সহকারীদের কাছে এবং তাদের কাছেই শিখতে চাইলাম। টুকটাক টিপ্পনী যে ছিল না তা নয়। কিন্তু ওরা যেন একটু গর্বিত হলো। পরদিন থেকে ওদের টেবিলে গিয়ে বসতাম। প্রথম প্রথম তারা সঙ্কুচিত হয়ে পড়ত। আশ্বস্ত করে বললাম, পত্রিকা অফিসে একই টেবিলে বসে আমরা একত্রে কাজ করেছি। সেখানে ঊর্ধ্বতন-অধস্তন বলে তেমন কিছু নেই। যাই হোক অল্প কিছুদিনের মধ্যে প্রুফ রিডিংসহ বেশকিছু আমার জানা হয়ে গেল। সেই সময় হ্যান্ড কম্পোজসহ সবই ছিল ম্যানুয়েল যা আজকের কম্পিউটার যুগে ভাবাই যায় না।
এরই মধ্যে একদিন পরিচালক মহোদয় ডেকে খোঁজ-খবর জানতে চাইলেন। এক সময় হতাশকণ্ঠে বললেন, নবারুণের প্রকাশনা তিনমাস পিছিয়ে আছে। কীভাবে ‘আপটুডেট’ করা যায় তেমন একটা উদ্যোগ যেন আমি নেই। পত্রিকাটি ছাপা হতো তেজগাঁ সরকারি প্রিন্টিং প্রেস থেকে। যেখানে রয়েছে সবকিছুরই সুষ্ঠু ব্যবস্থা। তবু ‘নবারুণের’ এ নিশ্চল অবস্থা কেন! অগত্যা একদিন সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহকারী পরিচালককে নিজ পরিচয় দিয়ে দেখা করতে চাইলাম, তিনি সানন্দে আমন্ত্রণ জানালেন। ক’জন সাব-এডিটরসহ পরদিনই তার দফতরে হাজির হলাম। সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে কিছুটা অভিযোগের সুরে বললেন, এমন করে এর আগে আর কেউ তো আসেনি। ফাইল চালাচালির মধ্যে যত অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। সময়মত কপি পাওয়া যায় না, প্রুফও আসে না। আমাদের কী দোষ, বলুন!
মনে হলো আমার আগমনে তিনি অনেকটা খুশি হয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও গীতিকার হিসেবে নাকি আমি তার প্রিয় ব্যক্তি। তাছাড়া তিনি আমার মতো এককালে সাংবাদিক ছিলেন, দৈনিক সংবাদে। সোত্সাহে বললেন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি? সুযোগ পেয়ে বললাম, নবারুণ পত্রিকার বিগত দুটি সংখ্যাসহ কারেন্ট সংখ্যা একত্রে পেলে কৃতজ্ঞ হব। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট শাখার ফোরম্যানকে ডেকে পাঠালেন। ফোরম্যান সাহেব ওভার টাইমের আর্জি জানালেন এবং প্রয়োজনীয় পাণ্ডুলিপি পেলে যথাসময় তিন সংখ্যা একত্রে সরবরাহ করার আশ্বাস দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওভারটাইম মঞ্জুরের নিশ্চয়তা দিলেন। কী আশ্চর্য ম্যাজিকের মতো পরের মাসের প্রথম দিনেই তিন মাসের তিনটি সংখ্যার শত শত কপি একত্রে অফিসে পৌঁছল। পরিচালক মহোদয় যেন বিস্মিত। দারুণ খুশি! আমাকে ডেকে অভিনন্দিত করলেন। এটা যেন তার কাছে এক অকল্পনীয় ব্যাপার।
কিন্তু আমি খুশি হতে পারলাম না। সূচিপত্রগুলো দেখলাম। অখ্যাত লেখকদের যতসব ছাইপাশ। বানানে আর ভাষায় প্রচুর ভুল। ঐতিহ্যবাহী অরুণ-বরণ-নবারুণের এমন দুরবস্থা!
ধনধান্য পুষ্পভরা বাংলাদেশের শিশু-কিশোর পত্রিকা কেমন হওয়া চাই? বর্তমানে উন্নত আধুনিক জীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কল্পনার জগত্। কিন্তু রূপ কথার সেই কল্পনার জগেক সুনিপুণভাবে ছোটদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশিয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। কিশোর মন আনন্দ পাবে এমন গল্প, এমন রহস্যজনক ঘটনা। লিখতে হবে সুখপাঠ্য বিচিত্র বিষয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশ, মাটি, মানুষ। গাছ, বাতাস, রোদ্দুর, সবকিছু হাজির থাকবে ছড়ায়, গল্পে। গল্পের ছলে এই পৃথিবীর যাবতীয় বৈজ্ঞানিক ঘটনার ব্যাখ্যা করে শিশু-কিশোরদের শিক্ষাকে মনোগ্রাহী করে তুলতে হবে। যাতে পড়ার বইয়ের বাইরে অন্য স্বাদ পায় তারা। অনাবিল সারল্যই হবে ছড়াগুলোর বৈশিষ্ট্য।
শুরু হলো আমার নিত্যদিনের এক কর্মসূচি। আদতে অত্যন্ত এক আমোদজনক চর্চা। প্রতিদিনই খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিকদের কারও না কারও সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ। বিশিষ্ট ছড়াকার হোসনে আরা, রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই), শামসুর রাহমান, ড. আব্দুল্লাহ আলমূতী শরফুদ্দিন, রফিকুজ্জামান (দাদুভাই), ড. হালিমা খাতুন, রাজিয়া মাহবুব প্রমুখ। অল্প সময়ের মধ্যে যেন অলৌকিক ভাণ্ডারের সন্ব্দান পেয়ে গেলাম। লেখা আসতে শুরু হলো এবং দ্রুত পরবর্তী সংখ্যার পাণ্ডুলিপি তৈরি করে যথাসময় প্রেসে পাঠিয়ে দিলাম। প্রবীণ-নবীন এবং সদ্য নবীনদের নিত্য কলরবে ‘নবারুণ’ ক্রমেই পল্লবিত ও পুষ্পিত হয়ে উঠল।

No comments

Powered by Blogger.