স্মরণ-বিজয়ের মাসে ভাস্বর স্মৃতি

বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আমি বেদনা ভারাক্রান্ত হই আমার পুরোনো দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিয়োগব্যথায়। দীর্ঘ প্রায় ষাট বছরের সাংবাদিকতার জীবনে যে স্বল্পসংখ্যক সাংবাদিকের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাঁদের মধ্যে এই দুজনকে হারাতে হয় মর্মান্তিক হূদয়বিদারক ঘটনায়। এঁদের কৃতি জীবনের সমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকালে। এঁরা হলেন দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক ও কবি শহীদ সাবের, অন্যজন সাংবাদিক নিজামুদ
আহমদ। বিবিসির সংবাদদাতা নিজামুদ্দীন আহমদকে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র চার দিন আগে তাঁর বাড়ির খাবার টেবিল থেকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদারদের এদেশীয় দোসর আলবদর, আলশামসের নরপশুরা। এর পর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
নিজামুদ্দীনের সঙ্গে আমার পরিচয় পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি এবং এর পরপরই তাঁর সঙ্গে গড়ে ওঠে ঘনিষ্ঠ সখ্য। সে সময় নিজামুদ্দীন থাকতেন ঢাকার পুরোনো শহর অঞ্চলের কলতাবাজার লক্ষ্মীবাজার এলাকায়, আর আমি থাকতাম নারিন্দার শরৎগুপ্ত রোডে। ঢাকার পুরোনো শহরে কোর্ট-কাচারির উল্টো দিকে জনসন রোডের ওপর জেলা বোর্ডের অফিস ভবনের পাশে কায়চুনবাড়ী লেনের মোড়ে ছিল ‘সাবেরিয়া’ নামে একটি বড় রেস্তোরাঁ। সাংবাদিক-সাহিত্যিকদের অনেকেই দুপুরে আর রাতের নিয়মিত খাবার খেতেন সেখানে। অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকত এই রেস্টুরেন্ট। নিজামুদ্দীন আর আমি বেশ রাত করে এই ‘সাবেরিয়া’ রেস্টুরেন্টে খাবার খেতাম নিয়মিত। কোনো দিন আমি আগে এলে অপেক্ষা করতাম নিজামুদ্দীনের জন্য আর নিজামুদ্দীন আগে এলে অপেক্ষা করতেন আমার জন্য। তারপর দুজনে খাওয়া শেষ করে রওনা দিতাম বাড়ির উদ্দেশে। কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো বা রিকশায়।
১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ নয় বছর পর দেশের একটি সংবিধান রচনা সম্ভব হয় এবং কর্মকর্তারা এই দিনটিকে প্রজাতন্ত্র দিবস ঘোষণা করেন। এই উপলক্ষে সেদিন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) আয়োজন করা হয় সামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তখন গভর্নর। তিনি এই কুচকাওয়াজে সামরিক বাহিনীর অভিবাদন নেবেন একটি মঞ্চ থেকে। গভর্নরের মঞ্চের পেছনেই খাটানো হয়েছে কয়েকটি শামিয়ানা আমন্ত্রিত অতিথি-দর্শকদের জন্য। তার একটি ছিল সাংবাদিকদের জন্য। নিজামুদ্দীন আর আমি সেখানে আসন পেয়েছি ভাগ্যের জোরে সামনের সারিতে। সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান চলাকালে হঠাৎ করেই সরকারি প্রচার দপ্তরের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের মুভি-ক্যামেরা তাক করা হলো আমাদের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে নিজামুদ্দীন তাঁর হাতের একটি বই ধরলেন আমার মুখের সামনে আমাকে ক্যামেরার দৃষ্টি থেকে আড়াল করার জন্য। বললেন, সরকারি তথ্যচিত্রে আমাদের ছবি দেখাতে দেব না। ঠিক তখনই মুহূর্তের মধ্যে আমার পকেট থেকে অপসৃত হলো একটি দামি ফাউন্টেন পেন পকেটমারের হাতের দক্ষতায়। আমার বিএ পরীক্ষার সময় আমার বাবা দিয়েছিলেন এই শেফার্স কলম। মনটা হঠাৎ করেই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার চেয়ে বেশি মন খারাপ হয়েছে নিজামুদ্দীনের। নিজামুদ্দীন বারবার বলছিলেন, ‘আমি তখন দুষ্টুমি না করলে পকেটমারের হাতে কলমটি যেত না। এর পরও বহুদিন ভুলতে পারেননি নিজামুদ্দীন এই ঘটনা, কেবলই দোষী মনে করেছেন নিজেকে।
ষাটের দশকে ঢাকায় বেসরকারি বার্তা সংস্থা পিপিআইয়ের সার্বিক পরিচালনার কর্তৃত্বে ছিলেন নিজামুদ্দীন। তাঁর দপ্তর ছিল তখনকার জিন্নাহ্ এভিনিউতে, এখন যেটি বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। সেখানে প্রায়ই দীর্ঘ আড্ডায় বসতাম আমরা বেশ কয়েকজন বন্ধু। নিজামুদ্দীন উদারভাবে চা-নাশতায় আপ্যায়ন করতেন আমাদের। পিপিআইয়ে নিজামুদ্দীনের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন গোলাম রসুল মল্লিক, যিনি পরে ‘এনা’ নামে স্বতন্ত্র একটি বার্তা সংস্থা পরিচালনা করেন। আরেকজন মোফাজ্জল হোসেন। মোফাজ্জল স্বাধীনতার পরে বিএসএস বার্তা সংস্থায় যোগ দেন এবং অবসর নিয়ে এখন তিনি লন্ডনপ্রবাসী। নিজামুদ্দীন তাঁর এই দুই সহকারী সাংবাদিককে খুবই ভালোবাসতেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজামুদ্দীন নিয়মিত খবর পাঠাতেন লন্ডনে বিবিসিকে। বিবিসির প্রচারিত নিজামুদ্দীনের পাঠানো খবরাখবর ছিল বস্তুনিষ্ঠ এবং তাতে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি প্রতিফলিত হতো পূর্ণাঙ্গ ও সঠিকভাবে। পাকিস্তানি শাসকদের কাছে এটাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অপরাধ। নিজামুদ্দীন সে সময় দেশের নানা প্রান্ত থেকে খবর সংগ্রহ করেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু এর পরও তাঁকে স্বাধীনতার মাত্র চার দিন আগে বাড়িতে খাবার টেবিল থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা কখনো করতে পারেননি তাঁর পরিবারের কিংবা বন্ধুবান্ধবের কেউ।
এর দীর্ঘকাল পর নিজামুদ্দীনের স্ত্রী এসেছিলেন ওয়াশিংটনে সম্ভবত ১৯৯২ অথবা ১৯৯৩ সালে। বাংলাদেশের বর্তমান দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান ছিলেন তখন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের ইকোনমিক কাউন্সিলর। আমার যত দূর মনে পড়ে, তাঁর বাড়িতে উঠেছিলেন নিজামুদ্দীনের স্ত্রী। গোলাম রহমান সাহেব আমাকে টেলিফোনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে ডিনারে যোগ দিয়ে নিজামুদ্দীনের স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের এবং অনুরোধ করেছিলেন ভয়েস অব আমেরিকায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার প্রচারের। নিজামুদ্দীনের স্ত্রীকে তখন দেখেছিলাম স্বামী হারানো বেদনার এবং সদ্য কন্যার মৃত্যুর শোকে বিধ্বস্ত। তিনি আমেরিকায় আসার স্বল্পকাল আগেই তাঁর বড় মেয়ে শারমীনকে হত্যা করে স্বামী মনির হোসেন। নিজামুদ্দীনের কথা বলতেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল তাঁর। এ অবস্থায় সাক্ষাৎকার নেওয়া সম্ভব হয়নি শেষ পর্যন্ত। পরে শুনেছি, তাঁর প্রয়াণ ঘটে তাঁর নিহত কন্যা শারমীনের স্বামী মনির হোসেনের ফাঁসির পরেই।
পাকিস্তানি নরপশু এবং তাঁদের এদেশীয় দোসর হায়েনাদের থাবায় বিধ্বস্ত হয়েছে নিজামুদ্দীন আহমদের মতো শহীদদের পরিবার। কিন্তু তাঁদের অনন্য ত্যাগের অমর স্মৃতির বিস্মরণ ঘটবে না কোনো কালে।
সৈয়দ জিয়াউর রহমান
ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের সাবেক সিনিয়র এডিটর

No comments

Powered by Blogger.