বিদায়ী ডেপুটি গভর্নরদের পরামর্শ-ব্যাংক খাত গোছাতে হবে

ব্যাংক খাতকে নতুনভাবে গোছানোর সময় হয়েছে। এর জন্য বড় ধরনের সংস্কারকাজের মধ্যে ঢুকতে হবে এই খাতকে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এই নতুন ভাবনার পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদায়ী তিন ডেপুটি গভর্নর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন ডেপুটি গভর্নর নজরুল হুদা, জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী ও মুরশিদ কুলী খান গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁদের শেষ কর্মদিবসে পৃথকভাবে প্রথম আলোর কাছে এ অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনজনই ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ


বিনিয়োগের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। তিন ডেপুটি গভর্নরই বাংলাদেশ ব্যাংকে একই সঙ্গে সহকারী পরিচালক পদে যোগ দিয়ে ডেপুটি গভর্নর পর্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন। আবার একই সঙ্গে তাঁরা বিদায় নিলেন।

নজরুল হুদা
‘আমি মনে করি, একটা বড় সংস্কার-কাজের মধ্যে ঢুকতে হবে। এর আগে বিগত সরকারগুলো দুই দফায় কমিটি করে বড় ধরনের সংস্কারকাজ করেছে। এখন বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে আবারও ব্যাংক খাতে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।’ বলেন নজরুল হুদা।
নজরুল হুদা বিগত সময়ে ব্যাংক খাতের সংস্কার কমিটিগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থেকেছেন। একই সঙ্গে তিনি আইএমএফের বিশেষজ্ঞ হিসেবে মালদ্বীপে গিয়ে আর্থিক খাত সংস্কার বিষয়ে মূল দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
নজরুল হুদা বলেন, মুনাফা নয়, বরং স্থিতিশীলতার বিষয়টিতে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেবল মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে স্থিতিশীলতা রাখা কঠিন হবে। তবে তিনি বলেন, ‘আশার কথা, ব্যাংক খাতের এখনো স্থিতিশীলতা বজায় রয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে, তবে তা সংকট বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।’
পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণ ও তারল্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকগুলো আরও মনোযোগী হলে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা অনেক সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।

জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী
বৈদেশিক বিনিময়, মুদ্রানীতি ও মানি লন্ডারিং বিষয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে দুটি ক্ষেত্রে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির আদলে বাজারব্যবস্থার ওপর প্রভাব রক্ষা করে চলা। আর সরকারকে সস্তায় বিদেশি ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে পাইপলাইনে থাকা বিভিন্ন ধরনের বিদেশি ঋণের অর্থ ছাড় করাতেও সরকারকে অধিক তৎপর হতে হবে বলে মনে করেন তিনি। দেশের বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা রক্ষায় এই পরামর্শ তাঁর।
জনাব সিদ্দিকী বলেন, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা দিয়ে এত দিন ইসলামি ব্যাংকগুলোর তারল্য প্রবাহের ওপর কোনো প্রভাব বিস্তার করা যাচ্ছিল না। কিন্তু ইতিমধ্যে ইসলামি আন্তব্যাংক বাজার সৃষ্টির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে এই ব্যাংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একধরনের নিয়ন্ত্রণ আসবে।
জনাব সিদ্দিকী পরামর্শ দেন, বৈদেশিক বিনিময়ের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তদারকি ও নজরদারি বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মনোযোগী হতে হবে।

মুরশিদ কুলী খান
দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংক খাতের নজরদারি ও তদারকির দায়িত্ব পালন করেছেন মুরশিদ কুলী খান। ব্যাংক খাতে অনেকগুলো মানদণ্ড তৈরিতে সরাসরি তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন ক্রমান্বয়ে দুর্বল বা ক্ষীণ হচ্ছে, যার কারণে ব্যাংকগুলোতে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ কমে আসছে। সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের ব্যাংকের ক্ষেত্রে একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে। তিনি ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে আরও দায়িত্ববান এবং উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কেবল নীতিনির্ধারণীর মধ্যে নিজেদের কাজ সীমাবদ্ধ রাখতে পরামর্শ দেন।
মুরশিদ কুলী খান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিভিন্ন ধরনের মানদণ্ড অনুসারে ব্যাংকগুলো সম্পর্কে মূল্যায়ন করছে, ব্যবস্থা নিচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেও নিজস্ব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে শক্ত ভূমিকায় থেকেছে। এটা ভবিষ্যতে অব্যাহত থাকবে বলে আমি আশা করি।’ তিনি আরও বলেন, কোনো ব্যাংকের মূলধন কম হলেও ব্যাংকটি টিকে থাকে। কিন্তু তারল্য ব্যবস্থাপনা যথাযথ হতে হবে। ব্যাংকগুলোকে মৌলিক ঝুঁকি বিবেচনা করে ঋণ বিতরণের পরামর্শ দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.