শিক্ষক ও পরীক্ষা by তিতাশ চৌধুরী

শিক্ষক এবং পরীক্ষা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিক্ষককে বাদ দিয়ে পরীক্ষা সম্ভব নয়, তাই পরীক্ষার জন্য শিক্ষক এক অপরিহার্য অঙ্গ। আমাদের দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থায় যদি শিক্ষক ছাড়া পরীক্ষা নেয়ার পদ্ধতি চালু হতো যেমনটা হয়েছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাহলে ব্যাপারটা চমত্কার হতো। অবশ্য এ নিয়ে অনেকবারই উচ্চমহলে আলাপ-আলোচনা হয়েছে—কিন্তু এর ফলাফল ভালো ছিল না। একটি প্রস্তাব ছিল প্রত্যেক জেলায় এবং উপজেলায় আলাদাভাবে পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা থাকবে।
এতে শিক্ষক নয়, ভিন্ন পেশার লোকজন পরীক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন। অথবা পরীক্ষা নেয়ার জন্য জেলা-উপজেলা পৃথক কমিটিতে থাকবে—তারাই দায়িত্ব পালন করবে। উত্তরপত্র বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। তবে এ দায়িত্বটা থাকবে শিক্ষা বোর্ডের ওপর। শেষ পর্যন্ত এর কোনো প্রক্রিয়াই কার্যকর হয়নি। কারণ, এর জন্য অবকাঠামো ছিল। তা হয়তো নানা কারণেই সম্ভব ছিল না। স্বাধীনতার পর পরীক্ষায় নকল বন্ব্দের জন্য অনেক পদক্ষেপই নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই আলোর মুখ দেখতে সমর্থ হয়নি। পরীক্ষায় নকল বন্ব্দের প্রধান দায়িত্ব বর্তায় শিক্ষকদের ওপর। যে সরিষায় ভূত থাকে সে ভূত আর তাড়ানো সম্ভব হয় না—শত চেষ্টা সত্ত্বেও। আমাদের সম্মানীত শিক্ষকদের (স্কুল/কলেজ) সদিচ্ছার ওপরই মোটামুটি নকল হওয়া না হওয়া নির্ভর করে। তারপর কলেজ বা স্কুল প্রশাসন—সবারই এ ব্যাপারে সহযোগিতা দরকার ছিল। মোট কথা, সর্বত্র সমন্বয়হীনতার জন্য মূলত পরীক্ষায় নকল হয়েছিল।
আমার মনে আছে—আমি তখন একটি নামকরা সরকারি কলেজের প্রিন্সিপাল। ফলে আমাকে নানা পরীক্ষা কেন্দ্র দর্শনে যেতে হয়েছিল। সঙ্গে জেলা প্রশাসন/বোর্ড প্রশাসনের কর্মকর্তারাও থাকতেন। কেন্দ্রে গিয়ে যা দেখা যেত—তা অবাক করার মতো ঘটনা। কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর চেয়ে অভিভাবক ও নকল সরবরাহকারীর সংখ্যাই অধিক থাকত। পুলিশ/আনসারের পক্ষে এতবড় জনতাকে তাড়ানো নানা কারণেই সম্ভব হতো না। কেন্দ্রগুলোতে নকলের যে কত রকম কায়দা ছিল তা আজ এর বর্ণনা দেয়াও অসম্ভব। জাতি এভাবেই শুধু সনদধারী নকল মানুষ তৈরি করেছিল। ফল হয়েছিল, এই নকল তুষ্টিপত্রধারী এই জনতা কোনো চাকরি-পরীক্ষায়ই টিকতে পারত না, মুষ্টিকয়েক ব্যতীত। এ দৃশ্য প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে কলেজ— এমন কি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল।
এ ব্যাপারে অনেককেই ব্যঙ্গ করে বলতে শুনেছি—আমাদের বিয়েটার জন্যই বিএ পাস সার্টিফিকেট দরকার। এর অধিক কিছু নয়। আরেক মহল আছে তাদেরও একটি ডিগ্রির সনদ দরকার ব্যবসাপাতি/কন্টাক্টারির জন্য। আসলে পরীক্ষায় নকল হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি ভয়ানক সামাজিক ব্যাধির মতো। আমি একবার একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নির্বাচনের জন্য ইন্টারভিউ নিতে গিয়েছিলাম। সেই স্কুলে চারজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হবে। গিয়ে দেখি, চারজনের মধ্যে তিনজনই মহিলা, একজন পুরুষ। পরীক্ষার্থী ছিল অনেক। তন্মধ্যে উপর্যুক্ত নিয়মে চারজনকে নিয়োগ দিতে হবে। একেক জনের ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে আকাশ থেকে পড়ে গেলাম। যারা বিএ পাস—তারা ‘বিএ’ শব্দটার ব্যাখ্যা করতে পারেননি। পারেননি বানানও। বর্ণমালা সম্পর্কেও খুব একটা জ্ঞান ছিল না। ব্যঞ্জনবর্ণের দুটো বর্ণ উচ্চারণ করতে বলেছিলাম। উত্তর শুনে থ বনে গিয়েছিলাম। বর্ণ দুটি—একটি চন্দ্র বিন্দু, অন্যটি বিসর্গ। এ সবই ছিল নকলের ফল। আমি যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘তুমি কিছুই জান না, তোমাকে নির্বাচিত করি কিভাবে? একটি মেয়ে খোলাখুলিই আমাকে বলল, ‘স্যার, পরীক্ষা তো আমি দেইনি। আমার পক্ষে অন্য একজন পরীক্ষা দিয়েছিল।’ মেয়েটির সততায় আমি খুশি হয়েছিলাম, কিন্তু আমি কাউকে স্কুলের শিক্ষকের জন্য নির্বাচিত করতে পারিনি। সেদিনের পরীক্ষার দৃশ্যগুলো ছিল শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে দুঃস্বপেম্নর মতো। আজ সেদিন নেই। শিক্ষার জন্য সুদিন এসেছে। সরকার শিক্ষার ওপর জোর দিচ্ছে। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড—এ কথাটা তখনই তাত্পর্যময় হয়ে উঠবে, যখন আমরা সত্যিকার অর্থে শিক্ষার ফল ভোগ করব। আসলে শিক্ষক যদি সত্ হন, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা দিতে আগ্রহী হন তাহলে ছাত্ররা বেপথে যেতে পারে না। শিক্ষক, শিক্ষকের উদ্দেশ্য যদি মহত্ না হয়, কোচিং নিয়েই ব্যস্ত থাকেন—তাহলে প্রকৃত শিক্ষা হবে না। অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী প্রশ্ন করেছিলেন—ছাত্ররা পরীক্ষায় ফেল করে কেন? আমি বলব—ওই কারণেই ছাত্ররা পরীক্ষায় ফেল করে। শিক্ষা যদি বাণিজ্য হয়, তাহলে প্রকৃত শিক্ষা হবে না। প্রকৃত শিক্ষার জন্য আত্মোন্নতিই দরকার। আর্থিক উন্নতি নয়।
স্বাধীনতার কিছু আগে থেকেই আমি শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম। স্বাধীনতার পর নকল শুরু হয় ব্যাপক হারে। একবার আমি পরীক্ষায় ডিউটিরত, এমন সময় একটি ছেলে আমাকে একটি প্রশ্নের উত্তর কি হবে—জিজ্ঞেস করেছিল। আমি কিছুই বলিনি। পরীক্ষায় এসেছিল ‘বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়’। ছাত্রটি যে নকলের পাতাটি নিয়ে এসেছিল, তাতে ছিল আলাউদ্দীন খিলজি। শেষাবধি সে পরীক্ষার উত্তরপত্রে আলাউদ্দীন খিলজিই লিখে দিয়ে এসেছিল। এটি হলো পড়াশোনা না করার ফল। আরেকবার এক ছাত্র পরীক্ষার উত্তরপত্রে ‘দেশপ্রেম’ রচনার সঙ্গে ‘গরু’ রচনাও লিখে দিয়ে এসেছিল। এর কারণ যে চোতাটি ছাত্রটি নকল হিসেবে এনেছিল, তার শেষে ‘দ্য কাউ’ ছিল। সুতরাং সে মনে করেছে ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ রচনার অংশ বিশেষই ছিল বোধ হয় ‘দ্য কাউ’। একজন ছাত্র কতটা অবুঝ হলে (গরু নয়) এ কাজটি করতে পারে। আজ পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। শিক্ষায়ও তা লাগুক জোয়ারের মতো। তাতে জাতি নতুন করে জেগে উঠবে।
লেখক : কবি, গবেষক, প্রাবন্ব্দিক, শিক্ষাবিদ ও অলক্ত সম্পাদক

No comments

Powered by Blogger.