রেশমি রুমাল আন্দোলনঃ পেরিয়ে গেল একশ’ বছর by ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ব্যবসায় হ্যাঁ, ব্যবসায়ের জন্যই এসেছিল ইংরেজরা। সবাই এমনকি বিলাসিতায় মত্ত থাকা তৎকালীন মোগল সম্রাটেরাও জানত ইংরেজদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ব্যবসায়ের জন্যই এসেছে।
কিন্তু পরে দেখা গেল এটা ছিল ইংরেজদের প্রতারণা। ব্যবসায়ের আড়ালে মূলত তারা এসেছে ভারতের শাসনমতা দখলের জন্য। একপর্যায়ে তারা মুসলমানদের কাছ থেকে শাসনমতা ছিনিয়ে নেয়। মতার মসনদে বসে ইংরেজরা এ দেশে শোষণ-নিপীড়নের শাসন চালাতে থাকে। ইংরেজদের দুঃশাসন থেকে মুক্তি পেতে বিপ্তি কিছু বিদ্রোহ হয়। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থ হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষ ইংরেজদের উড়ে এসে জুড়ে বসা দুঃশাসনকে অগত্যা মেনে নেয়। কিন্তু চিরস্বাধীনতাকামী আলেমসমাজ সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। রেশমি রুমাল আন্দোলন তারই একটি অংশ। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহ:। মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহ: ১৮৫১ সালে বেরেলিতে এক বিদ্বান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মাওলানা জুলফিকার আলী সরকারি শিা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর ছিলেন। মাওলানা মাহমুদুল হাসান চাচা মাওলানা মাহতাব আলীর কাছে থেকে প্রাথমিক শিা গ্রহণ করেন। ১৮৬৬ সালে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইসলামি বিদ্যাপীঠ ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হলে তাকে সেখানে ভর্তি করানো হয়। তিনি হচ্ছেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছাত্র। লেখাপড়া শেষে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে সহকারী শিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। শিকতার মহান পেশার মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত একদল ছাত্র গড়ে তোলেন। তিনি ১৯০৯ সালে তার একনিষ্ঠ শিষ্য স্বাধীনচেতা মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে জমিয়াতুল আনসার নামে এক সংগঠনের পতাকাতলে সব ছাত্রকে সমবেত করার নির্দেশ দেন। এরপর ভারতকে ব্রিটিশ আগ্রাসন থেকে মুক্ত করার জন্য শাইখুল হিন্দ রহ: ‘আজাদ হিন্দ মিশন’ নামে একটি বিপ্লবী পরিষদ গড়ে তোলেন। একটি চূড়ান্ত বিপ্লবের মাধ্যমে ইংরেজদের এ দেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করাই ছিল তার স্বপ্ন। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তিনি আন্তর্জাতিকভাবে আন্দোলন শুরু করেন, যা ইতিহাসে রেশমি রুমাল আন্দোলন নামে সমধিক পরিচিত। উল্লেখ্য, এটাই ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিশ্ব দু’টি অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক দিকে ছিল ইংল্যান্ড এবং তাদের মিত্র শক্তি ফ্রান্স, ইতালি, রাশিয়া, বেলজিয়াম ও জাপান। অপর দিকে কেন্দ্রীয় শক্তি হিসেবে তাদের বিপরীতে ছিল জার্মান, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও তুরস্ক। এ সময় শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান তুির্ক ও আফগান সরকারের সাথে এই ঐকমত্যে উপনীত হন যে, তুর্কি বাহিনী নির্ধারিত সময়ে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে এসে ব্রিটিশ-ভারতে আক্রমণ করবে এবং একই সময় ভারতবাসীও একযোগে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে। এভাবে ব্রিটিশদের উৎখাত করে তুির্ক বাহিনী বিপ্লবী সরকারের হাতে মতা ছেড়ে দিয়ে স্বদেশে ফিরে যাবে। পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় আক্রমণের জন্য নির্ধারিত তারিখটি হবে ১৯১৭ সালের ১৯ ফেব্র“য়ারি। এ সময় ইংরেজ সরকার বেশ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাজনৈতিক নেতাদের ধরপাকড় শুরু হয়। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জাওহার, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ও মাওলানা শওকত আলী প্রমুখ ব্যক্তি গ্রেফতার হলে শাইখুল হিন্দ তার শিষ্য মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে কাবুল চলে যেতে বলেন। আর তিনি নিজে রওনা হন হিজাজের পথে। হিজাজ তখন ছিল তুরস্কের শাসনাধীন। শাইখুল হিন্দ তার পরিকল্পনা নিয়ে হিজাজের গভর্নর গালিব পাশার সাথে কথা বলেন। এরপর মদিনায় তুরস্কের যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার সাথে তার বৈঠক হয়। উভয়ের মাঝে সর্বাত্মক সহযোগিতার চুক্তি স্বারিত হয়। শাইখুল হিন্দ আনোয়ার পাশাকে দিয়ে আফগান সরকারের উদ্দেশে পত্র লিখিয়ে নেন। তাতে লেখা ছিলÑ ‘আফগান সরকারের সম্মতি থাকলে ১৯১৭ সালের ১৯ ফেব্র“য়ারি তুর্কি বাহিনী আফগান সীমান্তের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ-ভারত আক্রমণ করবে এবং সাথে সাথে ভারতের অভ্যন্তরেও বিদ্রোহ ঘটবে।’ পত্রটি আফগানিস্তানে অবস্থানরত মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধির কাছে পৌঁছানো হয়। তার নেতৃত্বে ভারতীয় নেতারা পত্রটি নিয়ে আফগান বাদশাহ হাবিবুল্লাহর সাথে সাাৎ করেন। ইংরেজদের কাছে নতজানু হওয়ার কারণে বাদশাহ হাবিবুল্লাহ বিষয়টি ভালোভাবে গ্রহণ করলেন না। তবে পরিস্থিতির চাপে তিনি ভারতীয় নেতাদের সাথে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন। মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি ও আমির নাসরুল্লাহ খান চুক্তির বিষয়বস্তু ও ভারত আক্রমণের তারিখ আরবিতে রূপান্তর করেন। এরপর একজন দ কারিগর দ্বারা একটি রেশমি রুমালের গায়ে সেই আরবি ভাষ্য সুতার সাহায্যে অঙ্কিত করে মক্কায় অবস্থানরত শাইখুল হিন্দ রহ:-এর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, যাতে ব্রিটিশ বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে খবরটি নির্বিঘেœ পৌঁছানো যায়, একজন কাপড় ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সিন্ধুর শায়খ আবদুর রহিমের কাছে রেশমি রুমালরূপী পত্রটি পৌঁছানো হয়। যাতে হজে গিয়ে তিনি তা শাইখুল হিন্দ রহ:-এর হাতে পৌঁছে দেন।

অপর দিকে বাদশাহ হাবিবুল্লাহ বিরাট অঙ্কের আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে এসব গোপন তথ্য ইংরেজদের সরবরাহ করেন। ফলে গোয়েন্দা পুলিশ শায়খ আবদুর রহিমের বাড়ি তল্লাশি চালিয়ে রেশমি রুমালরূপী পত্রটি উদ্ধার করে। ইংরেজবিরোধী গোপন তৎপরতার কথা ফাঁস হয়ে যায়। শুরু হয় নেতাকর্মীদের ধরপাকড়। ইতোমধ্যে ইংরেজদের মদদপুষ্ট শরিফ হুসাইন হিজাজে তুির্ক শাসনের অবসান ঘটিয়ে মতায় অধিষ্ঠিত হন। গালিব পাশা, শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান, সহযোগী মাওলানা উযায়ের গুল, মাওলানা ওয়াহিদ আহমদ ও মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানিকে গ্রেফতার করা হয়। ইংরেজরা শাইখুল হিন্দ রহ:কে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পর্যাপ্ত রেকর্ডপত্র না থাকায় তারা আপসহীন স্বাধীনতা সংগ্রামী এই নেতাকে ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ মালটায় নির্বাসনে প্রেরণ করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের চূড়ান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো প্রেরণের জন্য রেশমি রুমালকে মাধ্যম বানানোর কারণে এই ঘটনাটি ইতিহাসে রেশমি রুমাল আন্দোলন নামে বিশেষ পরিচিতি লাভ করে।

রেশমি রুমাল আন্দোলন হয়েছিল ১৩৩৪ হিজরি (১৯১৬ সালে)। ১৩৩৪ থেকে ১৪৩৪। পেরিয়ে গেল এক শ’ বছর। শতবর্ষ পূর্তি উপলে ভারত সরকার গত ১১ জানুয়ারি রেশমি রুমাল আন্দোলনের ওপর ডাকটিকিট প্রকাশ করে। এতে দারুল উলুম দেওবন্দে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাজধানী নয়াদিল্লির বিজ্ঞান ভবনে আয়োজিত ডাকটিকিট প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জি বলেন, স্বাধীনতার জন্য শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান ও শাইখুল ইসলাম মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানির আত্মত্যাগের ইতিহাস নতুন জেনারেশনকে অবশ্যই জানতে হবে। ওই অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিসে শূরার সদস্য আনওয়ারুর রহমান। তিনি বলেন, আজ শাইখুল হিন্দ রহ:-এর অবদানকে স্বীকৃতি প্রদানের সাথে সাথে মূলত দারুল উলুম দেওবন্দের অবদানকে স্বীকৃতি দেয়া হলো। তথ্যমন্ত্রী শ্রী কপিল সিবাল বলেন, আমাদের স্মরণ রাখা উচিত, মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দিই মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ উপাধি প্রদান করেছিলেন। উত্তরাখন্ডের গভর্নর ড. আজিজ কুরাইশি বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে উলামায়ে কেরামের অবদানকে সিলেবাসভুক্ত করা উচিত। তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় তাদের যোগ্য আসন নিশ্চিত করা হয়নি।

ভারত দেরিতে হলেও ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে উলামায়ে কেরামের অবদানকে স্বীকৃতি দিলো। আর আমরা? এ দেশে কখনো ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হয়েছিল সে কথা আমরা একদম ভুলে গেছি। নাকি পরিকল্পিতভাবে ভোলানো হচ্ছে?

ahmadimtiajdr@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.