স্মরণ- ফকির মজনু শাহ

ঐতিহাসিক ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের মহানায়ক মজনু শাহের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। পলাশী-পরবর্তী জাতীয় দুর্যোগকালে তিনি স্বাধীনতার জন্য ইংরেজ-ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্ষমতা লাভের পর সর্বপ্রথম যে বিদ্রোহ ব্যাপকভাবে সংঘটিত হয়েছিল, তা ইতিহাসে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। আঠারো শতকের প্রথম ভাগে পশ্চিম ভারতের আলোয়ার রাজ্যের অন্তর্গত মেওয়াত, মতান্তরে উত্তর প্রদেশের কানপুর জেলার মাখনপুরে তার জন্ম এবং আনুমানিক ১৭৮৮ সালে উত্তরবঙ্গের কোনো এক জেলায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন, যা রহস্যঘেরা। ফকির মজনু শাহের জীবনকাল এবং প্রকৃত নাম জানা যায় না। ১৭৬০ সালে ফকির বিদ্রোহের সূত্রপাত। ১৮০০ সালে এই বিদ্রোহ স্তিমিত হয়ে পড়ে। মজনু শাহের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ফকির ও সন্ন্যাসীরা রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, ঢাকা, বীরভূম, মালদহ, পূর্ণিয়া (বিহার) প্রভৃতি স্থানে ইংরেজ শাসনবিরোধী তৎপরতা শুরু করেন। তাদের হামলার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইংরেজ কোম্পানির কুঠি, ফিরিঙ্গি শাসকের অনুগত জমিদারদের কাচারি এবং জমিদার-আমলাদের বাসস্থান। এই যুদ্ধে বিদ্রোহীরা তরবারি, বর্শা, বল্লম, বন্দুক, অগ্নিনিক্ষেপক যন্ত্র, হাওয়াই ও ঘূর্ণায়মান কামান ব্যবহার করতেন।

১৭৭২ সালে মজনু শাহ রংপুর, রাজশাহী ও বগুড়া জেলায় কোম্পানির বাণিজ্যকেন্দ্র ও আবাসন আক্রমণ করেন। ১৭৭৬ সালে বগুড়ার মহাস্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন। ১৭৮০ সালে মজনু শাহ বগুড়া জেলার কড়াইয়ে জমিদার শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা চাইলে তিনি পরিবার নিয়ে অন্যত্র চলে যান। ১৭৮১ সালে মজনু শাহ টাঙ্গাইলের মধুপুর জঙ্গলে আধিপত্য বিস্তার করেন। ১৭৮২ সালে ময়মনসিংহের আলপসিং পরগনায় ইংরেজদের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ফকির ও সন্ন্যাসীরা পরাজিত হন। ১৭৮৩ সালে লেফটেন্যান্ট ম্যাকডোনাল্ড একদল সৈন্য নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। দুই পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে প্রবল যুদ্ধ হয়। ১৭৮৫ সালে মহাস্থানগড় অভিমুখে অগ্রসর হলেও সেখানে এক যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে মজনুর দল পরাজিত হয়। পরেরবার তিনি পূর্ব ও উত্তরবঙ্গে যুগপৎ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ফকির সন্ন্যাসীরা দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন।

বগুড়া জেলার নিকটবর্তী কালেশ্বর এলাকায় লেফটেন্যান্ট ব্রেনানের বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে (৮ ডিসেম্বর ১৭৮৬) মজনু শাহের বহু অনুসারী নিহত হন। এই অভিযানকেই মজনু শাহর সর্বশেষ অভিযান বলে মনে করা হয়। এই অভিযানে ব্রেনানের হাতেই মজনুর অন্যতম সহযোগী বহুলালোচিত ভবানী পাঠকের মৃত্যু হয়েছিল। সম্ভবত কালেশ্বরের যুদ্ধে মজনু শাহ আহত হন এবং ১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারি উত্তর ভারতের কানপুর জেলার মাখনপুরে শাহ মাদারের দরগায় ইন্তেকাল করেন। আজো সেখানে অনেক ধার্মিক মাজার জিয়ারত করে থাকেন।

মো: জোবায়ের আলী জুয়েল
       

No comments

Powered by Blogger.