সোনারগাঁওয়ের কারুশিল্প মেলা জমে উঠেছে by হাসান মাহমুদ রিপন

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনে মাসব্যাপী লোক কারুশিল্প ও লোকজ উৎসব জমে উঠেছে।
গত শুক্র ও গতকাল শনিবার ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের ঢল নামে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দলবদ্ধভাবে লোকজন আসছে এ মেলায়। শিাসফর, বনভোজন, আনন্দভ্রমণ, ঘুরে আসি, পিকনিক ইত্যাদি ব্যানারে দল বেঁধে হাজার হাজার মানুষ আসছে এখানে। এক কথায় সোনারগাঁওয়ে লোক কারুশিল্প মেলা প্রাঙ্গণ এখন মুখরিত। বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন লোকজ ঐতিহ্যকে লালন এবং চলমান জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে গত ১৪ জানুয়ারি থেকে মাসব্যাপী মেলা শুরু হয়েছে। মেলা উপলে পুরো ফাউন্ডেশন চত্বর ভিন্ন সাজে সাজানো হয়েছে। গতকাল শনিবার মেলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে মেলা চত্বরে দর্শনার্থীর ঢল। সোনারগাঁওয়ে ভ্রমণে বা পিকনিকে এসে মেলাকে বাড়তি পাওনা হিসেবে উল্লেখ করছেন অনেকেই। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে শিাসফরে আসা কলেজের শিার্থীরা বলেন, এখানে শিাসফরে এসে সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন রাজধানীর ইতিহাস-ঐতিহ্য দেখার সাথে বাড়তি পাওয়া হিসেবে মেলাটি উপভোগ করলাম।

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি ও পুরান ঢাকা থেকে আগত দর্শনার্থী সাদেকুর রহমান, পলাশচন্দ্র সাহা, জাহাঙ্গীর আলম, সজীব, রুবিয়া ইসলাম, শান্তা, সেতু, আকাশসহ একদল তরুণ-তরুণী সোনারগাঁওয়ে পিকনিকে এলে তাদের সাথে দেখা হয় মেলা চত্বরে। তারা জানান, একুশে বইমেলা, ঢাকার বাণিজ্যমেলাসহ বিভিন্ন মেলার মতো সোনারগাঁওয়ের লোক ও কারুশিল্প মেলা দেশের একমাত্র লোকজ মেলা। এখানে বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া লোক ও কারুশিল্পকে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। তা দেখে নতুন প্রজন্মরা আরো বেশি করে জানতে পারবে। মেলা চত্বরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে লালনের একতারা। অনেক দর্শনার্থী একতারা কিনে হাতে নিয়ে বাজাতে বাজাতে হাঁটছেন। মেলায় সোনালী জামদানি স্টলের মালিক আবু তাহের জানান, মেলায় তার বেচাকেনা ভালোই চলছে। তবে শুক্র ও শনিবার একটু বেশি বেচাকেনা হয়। তার দোকানে রয়েছে বাহারি জামদানি শাড়ি। মেলায় ১৮০টি স্টল বসেছে। এর মধ্যে মণ্ডমিঠাই, হস্তশিল্প সামগ্রী, জামদানি, তাঁতবস্ত্র উল্লেখযোগ্য।

মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো, আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রদর্শনী দেশের প্রথিতযশা কারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘কর্মময় কারুশিল্প’ প্রদর্শনী। এটি মেলার মূল চত্বরের মাঠের মাঝে অবস্থান। এ বিশেষ প্রদর্শনীতে দেশের হারানো ঐতিহ্যকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করেছেন কারুশিল্পীরা। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলো শিল্পীরা সোনারগাঁওয়ের আবদুল আউয়াল মোল্লার কাঠ খোদাই, চিত্রিত হাতি-ঘোড়া, ঝিনাইদহ ও মাগুরার শোলাশিল্প, সোনারগাঁওয়ের নকশিকাঁথা, জামদানি, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি ও মুখোশ, টাঙ্গাইলের বাঁশ শিল্প, মুন্সীগঞ্জের শীতলপাটি ও পটচিত্র, মনিপুরী তাঁত, রংপুরের শতরঞ্জি, রংপুরের পাট ও বুনন শিল্প, চট্টগ্রামের হাতপাখা, কিশোরগঞ্জের মৃৎশিল্প (টেপা পুতুল), ধামরাইয়ের তামা-কঁাঁসা, সোনারগাঁওয়ের বেত শিল্প ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। এখানে শিল্পীরা বসেই তাদের নিপুণ হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছেন বাহারি কারুপণ্য এবং তা প্রদর্শন ও বিক্রি করছেন।

এ ছাড়া প্রতি শুক্র ও শনিবার আবহমান বাংলার গ্রাম্য সালিস, দাদী-নাতির গল্প বলা, লোকজ নকশিপিঠা তৈরি, পালকিতে বর, বর-কনে সাজা, পণ্ডিত মশাইয়ের পাঠশালা ইত্যাদি জীবন্ত প্রদর্শনী কারুশিল্প মেলার একপাশে চলছে। আবহমান বাংলার লৌকিক আচার এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে এ প্রদর্শনীতে। সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীরা এতে অংশগ্রহণ করছে। মেলায় নাগরদোলায়, বিমান চড়কি, পুতুল নাচ, সাপ খেলার পাশাপাশি নতুন যোগ হয়েছে হারিয়ে যাওয়া সার্কাস খেলা। ফাউন্ডেশনের পরিচালক কবি রবীন্দ্র গোপ জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও মেলায় আকর্ষণীয় বিভিন্ন খেলা, গান, প্রদর্শনী অনুষ্ঠান ছাড়াও গ্রামবাংলার আর্থসামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে বৈচিত্র্যময়ভাবে। মেলায় এ বছরের বিশেষ আকর্ষণ আমাদের হারিয়ে যাওয়া সার্কাস। মেলা চত্বরের পূর্ব পাশে সার্কাসমঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া লোকজ মঞ্চে লোকজ নাটক, সেমিনারের আয়োজনও আছে মেলায়।

মেলা চলবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

No comments

Powered by Blogger.