চার্জ শুনানি নিয়ে একটি প্রস্তাব by জাহিদ আহমেদ

ফৌজদারি মামলার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে চার্জ বা অভিযোগ শুনানি। এই শুনানির মাধ্যমে কোনো আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ বা চার্জ গঠন হয় নতুবা কোনো অভিযুক্ত আসামিকে ডিসচার্জ (অভিযোগ থেকে অব্যাহতি) দেওয়া হয়। তাই এই চার্জ শুনানি শুধু মামলার জন্যই না, একজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জীবনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


আরেকজন অভিযুক্ত ব্যক্তির জীবনের এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি বা মামলার এই মৌলিক ধাপটি যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং সময়ের মাধ্যমে সম্পূর্ণ হচ্ছে, কতটা স্বচ্ছ ও নিখুঁত হচ্ছে তা নিয়ে আজ খুবই যৌক্তিক কিছু প্রশ্ন আছে। অভিযোগপত্রে (চার্জশিটে) নাম অন্তর্ভুক্তীকরণ বা বাদ দেওয়ার যে সংস্কৃতি এই সমাজে প্রচলিত আছে, তা যে মোটেও সুখকর নয়, তা কমবেশি সবারই জানা। তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক পেশকৃত অভিযোগপত্র আমলে নেওয়ার পর পরই চার্জ শুনানির জন্য একটি দিন ধার্য হয়। অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাইমা ফেসি সত্যতা বা উপাদান আছে কি না অথবা তাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন কর্তৃক প্রস্তাবিত অভিযোগ গঠিত হবে কি না—এ বিষয়ে ওই ধার্য দিনে শুনানি হয়। সেই শুনানির পরই কার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হবে বা কাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে, তা নির্ধারিত হয়। তাই স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে, এই শুনানি মামলা ও অভিযুক্ত ব্যক্তির ভাগ্য নির্ধারণের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এ গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হয় অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিবন্ধকতার। প্রথমেই আসে সময়ের ব্যাপারটি। এটা সত্য যে প্রতিদিন মামলার প্রবাহ এতটাই বেড়ে চলছে যে আমাদের আদালতগুলোতে মামলার জট হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন আদালতের কার্যতালিকায় অনেক মামলার শুনানির জন্য নির্ধারিত থাকে। আদালত কক্ষে আইনজীবীসহ বিচারপ্রার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে। কিন্তু তার পরও অভিযোগ শুনানির সময় যেন সবাই একটু বেশিই অস্থির হয়ে যায়। তার বড় কারণ হলো, এই শুনানিতে যথেষ্ট সময় দরকার এবং এই চার্জ শুনানি অবশ্যই করতে হবে যথেষ্ট সময় নিয়ে এবং অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে অভিযোগপত্রসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক নথিভুক্ত কাগজপত্র পরীক্ষণের মাধ্যমে। প্রসিকিউশন ও ডিফেন্স দুই পক্ষকেই শুনতে হবে এবং তাদের নিজস্ব বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য যথেষ্ট সময় ও সুযোগ দিতে হবে। আমরা অবশ্যই চাইব না কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগ গঠিত হোক এবং দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর সে এই অসত্য অভিযোগের ঘানি টানুক। এবং আমরা সবাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমরা আইন অঙ্গনের মানুষ কখনোই এমনটি প্রত্যাশা করব না।
কিন্তু বাস্তব প্রতিবন্ধকতাগুলো অন্য কথা বলে। সময় নিয়ে শুনানি করতে গেলে সহ্য করতে হয় পেছন থেকে আসা অনেক তির্যক মন্তব্য, যেটাকে আমরা টিজ বলব না, তবে অনেকটা এ রকমই। মাঝেমধ্যে উপস্থিত সহযোদ্ধারা তাড়াতাড়ি শুনানি শেষ করার জন্য যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করে, তা যে শুধু একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকেই নয়; বরং পুরো পরিবারকেই ভিকটিমাইজড করছে, তা আমরা কতজনই বা উপলব্ধি করি। প্রসিকিউশনের পক্ষে থেকে চার্জ (অভিযোগ) ‘হয়ে যাক’ ধরনের যে প্রবণতা, তাও যেন অত্যন্ত ব্যথিত করে এবং এটা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কতটা সহায়ক, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। অর্থাৎ আইনে বলা আছে, অভিযুক্ত আসামিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সুশৃঙ্খলভাবে তাকে পড়ে শোনাতে হবে এবং শুধু তা-ই নয়, তাকে তা ব্যাখ্যা করতে হবে, তার পর সে যদি ‘গিল্টি প্লিড’ করে (দোষ স্বীকার করে) তাহলে তাকে কনভিকশন বা সাজা দেওয়া যাবে এবং সে যদি ‘নট গিল্টি প্লিড’ করে তাহলে প্রসিকিউশন সাক্ষীদের দ্রুত সমন ইস্যু করে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তাদের এক্সামিন বা পরীক্ষণ করতে হবে এবং দ্রুত রায়ের দিকে যেতে হবে।
চার্জ শুনানি-সংক্রান্ত তিক্ত অভিজ্ঞতা ও আত্মোপলব্ধি থেকে বলা যায় যে প্রসিকিউশন ও ডিফেন্সকে যথেষ্ট সময় দিয়ে শুনে ও নথিভুক্ত সব প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র পর্যালোচনা করে একজন অভিযুক্ত আসামিকে হয় মামলার দায় হতে অব্যাহতি দেওয়া হবে, নতুবা তার বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযোগ গঠিত হবে। অন্যথায় এর ব্যত্যয় হলে ন্যায়বিচারের বাণী শুধু নীরবে-নিভৃতে কেঁদেই যাবে।
লেখক  আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট

No comments

Powered by Blogger.