রোজা সহজ করে ভাবুন by লাবনী আহমেদ

রোজার মাস। বিশ্বের অন্যসব মুসলিম দেশে পুরো রোজার মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম অর্ধেকে নেমে আসে। সরকার ভর্তুকি দেয় , যাতে এ মাসে কেউ খাবার-দাবারে কষ্ট না করে। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টোটি। এ সময় দ্রব্যমূল্য আকাশ ছুঁতে চায় যেন! ফলে মাস আসার আগে এবং পুরো মাসজুড়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্থিরতা


চলতেই থাকে। সারাদিন উপোসের পর ইফতারের টেবিলটা ভরা দেখতে চায় সবাই। যার দিন আনতে পান্তা ফুরায় তারও ইচ্ছা হয় ইফতারে ভালো-মন্দ কিছু খাওয়ার। পরিবারের সব সদস্য হয়তো রোজা রাখছে না, সকাল থেকে চুলা জ্বলছে, তাহলেও ইফতারির টেবিলটা চাই জমজমাট । এটা আমাদের দেশের দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি । ইফতার আর সেহরির আয়োজনটা যদি ভালো না হয়, তাহলে আর রোজার মাস কিসের_ এমন মনোভাব অধিকাংশের । ফলে মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। গৃহিণীদের এ এক বাড়তি মাথাব্যথা যেন। কারণ আয়োজন যে তাদেরই করতে হয়। পরিবারের সবার সন্তুষ্টির দিকে খেয়াল রাখতে হয় তাদেরই। পাশের ফ্ল্যাটের আপাকে দেখেছি, চলতি মাসের শুরুতে মহাঅস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আমার কাছে জানতে চাইলেন আপা ছোলার কেজি এখন কত জানেন? দাম কি আরও বাড়বে! বুটের ডাল তো শবেবরাতের আগেই বেড়েছে। তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, বেগুন তো হু হু করে বাড়বে। কী যে করি! এমন যে শুধু ওনার ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত অনেককে দেখলাম রোজা না আসতেই খাবার সংরক্ষণে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন তারা। তাদের অবস্থা দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, কোনো কারণ ছাড়াই জীবনকে আমরা কত জটিল করে তুলতে পারি! দু'চার দিন পরই আপা জানালেন, পুরো রোজার বাজার করে ফেলেছেন তিনি। মাছ, মাংস কিনে ডিপফ্রিজ ভরে রেখেছেন। বাজারের যা ফিরিস্তি দিলেন তাতে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল, আপা আপনাদের মতো ক্রেতার জন্য জিনিসপত্রের দাম এত বেড়ে যায়। বললেন_ কী করব বলেন, রোজার মাসে তো আরও বেড়ে যাবে সবকিছুর দাম! খেতে তো হবে। বললাম , অন্যসব মাসে কি না খেয়ে থাকি আমরা! ছোলা ছাড়া কি ইফতার হয় না! বেগুনি, কাঁচামরিচ খাওয়া কি সুন্নত! উত্তর নেই তার মুখে।
রোজার মূল অর্থই হচ্ছে সংযম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সংযমী হওয়ার শিক্ষাই রোজার মূল শিক্ষা। ধর্মের শিক্ষা যদি সত্যিকার অর্থেই আমরা পালন করতাম তাহলে জীবন এত কঠিন এবং জটিল হয়ে উঠত না_ বললেন অধ্যাপক শায়লা নাসের। দুঃখ করেই বললেন, রোজার মাসে যেন আমরা অসংযমী হয়ে পড়ি বেশি। খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটার ব্যস্ততায় ইবাদতের কাজকে গৌন করে ফেলি। নারীরাই বাড়তি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন বেশি। দিন দিন বেড়ে চলেছে আমাদের আড়ম্বরতা! ইফতারের দাওয়াত করব, কত পদ করা যায় তা নিয়ে দিনভর চলে ব্যস্ততা। অহেতুক অর্থও খরচ হয়। অথচ পরিমিত আয়োজনে যে সর্বোচ্চ তৃপ্তি পাওয়া যায় তা ভুলে যাচ্ছি আমরা। একজনের দেখাদেখি অন্যজনের সামর্থ্য না থাকলেও করা চাই।
রোজার মাসকে আর ১০টা মাস থেকে খুব আলাদা করার কি কিছু আছে! । মাসের বাজারের সঙ্গে আমি এক কেজি করে ছোলা আর ডাল কিনে রেখেছি। চিনিও তাই। সামনের মাসের বাজারের সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী বাড়িয়ে কিনব। তেল বাড়াইনি। তেল বরং যতটা কমানো যায় সে চেষ্টাই থাকে সবসময়, বললেন নাইমা হক। হালকা এবং পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবারই ইফতারিতে রাখার চেষ্টা করি আমি। বাচ্চাদের ওভাবে অভ্যস্ত করে তুলেছি। তবে মাঝে মধ্যে ওদের চাওয়া অনুযায়ী ইফতারি বানাই। ফাস্ট ফুড আর রিচ ফুড খেয়ে চিকিৎসকের কাছে দৌড়াতে চাই না। রোজার মাসে গৃহকর্মীর ওপরও যাতে কাজের বেশি চাপ না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখি। চেষ্টা করি রোজার মূল উদ্দেশ্যকে বজায় রাখতে।
একেবারে সীমিত আয়ের পরিবার আমাদের। স্বামীর একা আয়ে ঢাকা শহরে সম্মানের সঙ্গে চলা খুব কঠিন। সেভাবে রোজার মাসের বাজেট করি। বললেন নার্গিস নাহার।সকালের নাস্তার বাজেটটা ইফতারির বাজেটে নিয়ে আসি। দুপুরের খাবারটা সেহরিতে ধরি। বুঝে চলা ছাড়া তো উপায় নেই। আমরা তো আর চুরি করতে পারব না। সরকারও সেভাবে খেয়াল করবে না। কড়া আইন থাকলে তা ভাঙার সাহস কারও হতো না। কিন্তু এগুলো বলে তো লাভ নেই। উপায়হীন হয়েই মেনে নিয়েছি সব। কষ্ট হয় বাচ্চাদের জন্য । অল্প বয়সই কঠিন বাস্তবকে দেখছে ওরা। নিজেকে বড় বেশি অসহায় মনে হয়। একজন মায়ের জন্য এ যে কত কষ্টের, বুঝবে, আমার মতো আরেক মা-ই।
 

No comments

Powered by Blogger.