আমিনুল হত্যায় সন্দেহের তীর শান্তা গ্রুপের দিকেই

আলোচিত শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ডে ঢাকা ইপিজেড এলাকার পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠান শান্তা গ্রুপের ওপর সন্দেহ বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যস্থতা করতে গিয়ে তাদের রোষানলে পড়েই আমিনুল খুন হতে পারেন- এমন আশঙ্কা তাঁর পরিবার, সহকর্মী ও স্থানীয় লোকজনের।


গোয়েন্দা পুলিশও জানিয়েছে, শান্তা গ্রুপের অসন্তোষকে ঘিরেই এই হত্যাকাণ্ড- এমন ক্লু ধরে মামলার তদন্ত এগিয়ে চলেছে। জানা যায়, শান্তা গ্রুপের কর্ণধার খন্দকার মনির উদ্দিন আমিনুলকে দেখে নেওয়ার প্রকাশ্যে হুমকিও দিয়েছিলেন অনেকবার। সর্বশেষ দেওয়া হুমকির পরই আমিনুলের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ায় এই গ্রুপ এবং এর মালিকদের প্রতি সন্দেহের তীর সবার।
প্রসঙ্গত, আমিনুল হত্যাকাণ্ড দেশের প্রধান রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক শিল্পকে বড় ধরনের সংকটে ফেলেছে। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে অন্যতম প্রধান আমদানিকারক দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে আমিনুল হত্যাকাণ্ড নিয়ে তাঁদের উদ্বেগের কথা সরকারকে জানিয়ে গেছেন।
স্থানীয়রা ও আমিনুলের একাধিক সহকর্মী জানান, গত ২২ মার্চ এশিয়া কাপ ক্রিকেটের ফাইনাল খেলা দেখা নিয়েই ঘটনার সূত্রপাত। শান্তা গ্রুপের একটি কারখানার শ্রমিকরা খেলা দেখার জন্য ওই দিন কারখানা বন্ধের দাবি করলে কর্তৃপক্ষ তাতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ওই সময় শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়।
আমিনুলের সহকর্মী ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের কর্মী লাবনী আক্তার জানান, ৪ এপ্রিল নিখোঁজ হওয়ার আগে আমিনুল ওই দিন বিকেলে তাঁদের অফিসে বসেই ওই কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন। ওই সময় আমিনুল শ্রমিকদের সঙ্গে বসেই ইপিজেডের এক কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। পরে তিনি শ্রমিকদের বলেন, 'আগামীকাল কারখানা খুলে দিতে পারে। কোনো সমস্যা করবে না। কারখানা চলুক আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করা হবে।'
লাবনী আক্তার আরো জানান, শান্তা গ্রুপের শ্রমিকরা চলে গেলে কুইন্স সাউথ নামের অপর একটি কারখানার শ্রমিক মোস্তাফিজ বোরকা পরা একটি মেয়েকে দেখিয়ে বলেন, 'ও পালিয়ে এসেছে, আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।' অনিচ্ছাসত্ত্বেও মোস্তাফিজের অনুরোধে জিরানী বাজার কাজী অফিসে গিয়ে বিয়েতে সহায়তা করতে রাজি হন আমিনুল। সন্ধ্যা ৭টার দিকে দুটি রিকশায় করে তাঁরা রওয়ানা হন। এর পরই নিখোঁজ হন আমিনুল। লাশ উদ্ধারের পর থেকেই মোস্তাফিজকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ রয়েছে বলে জানান লাবনী।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শান্তা গ্রুপের একাধিক কর্মী জানান, কারখানার মধ্যম পর্যায়ের কিছু কর্মকর্তার উসকানিতেই ওই শ্রমিক অসন্তোষ হয়। শ্রীলঙ্কা, ভারত ও মালয়েশিয়ার যৌথ মালিকানার ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলছিল। এ কারণে কিছু কর্মকর্তা তাঁদের অবস্থান জানান দেওয়ার জন্য কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে আমিনুল তাঁদের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
শিল্প পুলিশের এসপি গোলাম রউফ খান জানান, শান্তা গ্রুপের ওই প্রতিষ্ঠানটির ঘটনার সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে। যেদিন ওই গার্মেন্টে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে, সেদিনই নিখোঁজ হন আমিনুল।
এদিকে মামলার তদন্তের দায়িত্বে পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম দিকে তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ডিবির এসআই দুলাল। এখন তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে টাঙ্গাইল ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ূন কবিরকে। মামলাটি প্রথমে ঘাটাইল থানার পুলিশের কাছে থাকলেও ১৮ এপ্রিল টাঙ্গাইল ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়।
বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ূন কবির বলেন, 'মোস্তাফিজকে ধরা গেলেই খুনের রহস্য উদ্ধার হবে।' দায়িত্ব পাওয়ার পর মোস্তাফিজকে ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েছেন বলে জানান তিনি। তবে তদন্তের স্বার্থে এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি এই গেয়েন্দা কর্মকর্তা।
গত ৪ এপ্রিল নিখোঁজ হওয়ার পরের দিন লাশ উদ্ধার হয় আমিনুলের। কিন্তু এখনো মামলায় দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। এতে চরম হতাশ পরিবারের সদস্যরা। নিহত আমিনুলের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম ফাহিমার দাবি, যে বা যারাই আমিনুলকে হত্যা করুক না কেন, অবশ্যই পুলিশ এর সঙ্গে জড়িত।
এদিকে আমিনুলের পরিবারের সন্দেহের তালিকায় একটি গোয়েন্দা সংস্থাও রয়েছে। ওই সংস্থাটি ২০১০ সালে ১৮ জুন বিজয়নগর থেকে আমিনুলকে তুলে তাদের অফিসে নিয়ে গিয়েছিল। সেবার আমিনুলের পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল থেঁতলে দেওয়া ও ডান কানে আঘাত করা হয়েছিল। পরে আমিনুলকে ময়মনসিংহগামী একটি বাসে তুলে দেওয়া হয়। ওই বাস থেকে নেমে কৌশলে পালিয়ে আসেন আমিনুল। আমিনুলের লাশ উদ্ধারের পর তাঁর শরীরে যেসব স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ২০১০ সালের ১৮ জুনের নির্যাতনের সাদৃশ্য রয়েছে। বাড়তি আঘাত ছিল তার হাঁটুর নিচের ফুটো। এ থেকে বোঝা যায়, যারা আগে আমিনুলকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারাই পরের বার আমিনুলকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে থাকতে পারে- এমনটাই দাবি আমিনুলের স্ত্রীর। প্রথম দিকে দায়িত্ব পাওয়া তদন্ত কর্মকর্তা এসআই দুলাল পা থেতলে দেওয়া ও হাঁটুর নিচে ফুটো থাকার কথা নিশ্চিত করেছেন।
আমিনুলের সহকর্মীদের সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন তাঁদের দীর্ঘদিনের পরিচিত মোস্তাফিজ। এই মোস্তাফিজও গোয়েন্দা সংস্থার লোক ছিলেন বলেও দাবি তাঁদের। সন্দেহের তালিকায় থাকা এক গোয়েন্দা কর্মকর্তার সঙ্গে মোস্তাফিজের প্রায় ১০০ মিনিটের মতো ফোনে কথা হয়েছে- মর্মে তাঁদের কাছে নিশ্চিত তথ্য রয়েছে বলেও দাবি তাঁদের। আমিনুলের সহকর্মী ফাহিমা জানান, গোয়েন্দা সংস্থার ওই কর্মকর্তা তাঁকে প্রায়ই হুমকি-ধমকি দিতেন।
ওই কর্মকর্তার সঙ্গে আমিনুলের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হওয়ার বিষয়ে তাঁর সহকর্মীরা জানান, ২০১০ সালে কনভয় গ্রুপের জামগড়া ফ্যাক্টরিতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। তখন আমিনুল আলোচনায় বসার উদ্যোগ নিলে ওই কর্মকর্তা তাঁকে নাক না গলানোর জন্য হুমকি দেন। এর পরও রাজধানীর বিজয়নগরে বৈঠকে বসার জন্য শ্রম পরিচালকের অফিসে যান আমিনুল। ওই দিন অফিসের গেট থেকেই আমিনুলকে তুলে নিয়ে যায় গোয়েন্দা সংস্থাটি।
পলাতক মোস্তাফিজ ওই গোয়েন্দা সংস্থার পেইড সোর্স ছিলেন এবং এখন তাদের আশ্রয়েই রয়েছেন বলে দাবি করেছেন আমিনুলের এক সহকর্মী। তবে ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তার দাবি, মোস্তাফিজকে তাঁরা খুঁজছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমিনুলের এক সহকর্মী বলেন, 'ডিবি পুলিশ চার হত্যাকারী চিহ্নিত করেছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।'
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ১ জুলাই মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাঞ্চল্যকর মনিটরিং সেলে নেওয়া হয়েছে। এর পরও মামলায় গতি নেই বলে দাবি করেছেন আমিনুলের মেয়ে সায়মা আক্তার আঁখি।
কে এই মোস্তাফিজ : শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তিনি আগে শ্রমিক হিসেবে কাজ করলেও অনেক দিন ধরেই ইপিজেড এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের চর বা সোর্স হিসেবে কাজ করেছেন। আমিনুলের সহকর্মী লাবনী আক্তার বলেন, 'তার চলাফেরা ছিল সন্দেহজনক। প্রায় সময়েই সে আমাদের অফিসে আসা-যাওয়া করত।'
লাবনী বলেন, 'তাকে একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, সারা দিন এখানে থাকেন, কাজ করেন কখন? তখন তিনি উত্তরে বলেছিলেন, তিনি নাকি রাতে ডিউটি করেন। কিন্তু তার চেহারায় রাতে ডিউটি করার কোনো ছাপ দেখা যেত না।' অন্য একটি সূত্র দাবি করেছে, আশুলিয়া-আব্দুল্লাহপুর রুটে মোস্তাফিজের একটি ম্যাক্সি চলাচল করে।
মোস্তাফিজের গ্রামেরবাড়ি মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কাদিরপাড়া গ্রামে। তার বাবার নাম শমসের মল্লিক। সাংসারিক অনটনের কারণে এইচএসসিতে পড়ার সময় সে ঢাকায় চলে আসে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, দেড় বছর আগে সে কাউকে না জানিয়ে কুষ্টিয়ায় বিয়ে করে। কিন্তু কখনো স্ত্রীকে গ্রামের বাড়িতে নেয়নি। সর্বশেষ আড়াই মাস আগে বাড়িতে গিয়েছিল মোস্তাফিজ।
মোস্তাফিজের মা রিমা আক্তার জানান, ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে সে ষষ্ঠ। তার বাবা কৃষিকাজ করেন, তা দুই ভাই একটি বাহিনীতে কর্মরত। অন্য তিন ভাই কৃষিকাজ করেন।
সূত্র : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম।

No comments

Powered by Blogger.