অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে জটিলতা by এ কে এম আনোয়ারুল ইসলাম

মোট দাগে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সারকথা হলো, সরকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) আইন, ২০১১ কার্যকর হওয়ার পর ৩০০ দিনের মধ্যে তথা গত ১১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখ থেকে ৩০০ দিনের মধ্যে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে যেসব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা দেবে, সেই সব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ-


ট্রাইব্যুনাল বা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত জেলা কমিটি ভিন্নরূপ সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত সেই সব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে। সংশ্লিষ্ট সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরবর্তী ১২০ দিনের মধ্যে ওই সম্পত্তির মূল মালিক বা তাঁর উত্তরাধিকারী বা মূল মালিক বা উত্তরাধিকারী স্বার্থাধিকারী বা তাঁদের অনুপস্থিতিতে উত্তরাধিকার সূত্রে এমন সহ-অংশীদার যিনি বা যাঁরা ইজারা গ্রহণ দ্বারা বা অন্য কোনোভাবে সম্পত্তির দখলে রয়েছেন। যদি তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দা হন, তাহলে তাঁরা জেলা কমিটি কিংবা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ-সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালকে ওই সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বা অবমুক্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন।
নতুন আইন প্রবর্তনের আগে যথাযথ আদালত কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয় মর্মে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করে থাকলে তা অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্তকরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও তালিকাভুক্ত হলে ট্রাইব্যুনালের নিকট অবমুক্তির আবেদন করার বিধান করা হয়েছে। এই আইন প্রবর্তনের পর কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয় মর্মে কোনো সাধারণ আদালতে মামলা করার অধিকার রহিত করা হয়েছে। এই আইনের আওতায় কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত হলে ওই সম্পত্তি-সংক্রান্ত দেওয়ানি মামলা অনিষ্পন্ন থাকলে সেই মামলা বাতিল হয়ে যাবে। অর্পিত সম্পত্তির দুটি তালিকা প্রকাশ করা হবে—একটি ক. তফসিলভুক্ত, অপরটি খ. তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি হবে। খ তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তি অবমুক্তির জন্য জেলা কমিটির নিকট এবং ট্রাইব্যুনালের নিকট আবেদন করা যাবে, কিন্তু ক তফসিলভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির বিষয়ে আইনে উল্লেখ না থাকলেও যেহেতু কমিটির নিকট শুধু খ তফসিলভুক্ত সম্পত্তি অবমুক্তির আবেদন করা যাবে, অর্থাৎ ক তফসিলের অবমুক্তির এখতিয়ার শুধু ট্রাইব্যুনালের। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক কিছু বিধান করা হয়েছে। মূল আইনটি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন, ২০০১ নামে অভিহিত, যা বিগত ১১ এপ্রিল ২০০১ তারিখে গেজেট বিজ্ঞপ্তি হয়। কিন্তু আইনটি তৎকালে কার্যকর হয়নি। ফলে আইনটি পরিত্যক্ত আইনে পরিণত হয়েছিল। ২০১১ সালের ২৩ নম্বর আইন তথা অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) আইন, ২০১১-এর ৪ ধারা অর্থাৎ মূল আইনে ৯(১) ধারা অনুসারে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১ পুনর্জীবিত হয়। ওই সংশোধিত আইন অনুযায়ী ৩০০ দিনের মধ্যে গেজেটভুক্ত হয়নি এমন সম্পত্তি সরকার পরবর্তী সময়ে আর অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে দাবি করবে না! সম্পত্তির তালিকা গেজেটভুক্ত হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে কমিটি বা ট্রাইব্যুনালের নিকট আবেদন না করলে সেই সম্পত্তি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে এবং পরবর্তী সময়ে সেই সম্পত্তি সম্পর্কে আদালতে কোনো দাবি উত্থাপন করা যাবে না।
অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন একটি বিশেষ আইন। এই আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই। আইনটি ভুক্তভোগীদের জন্য যেমন একটি সুযোগ, ঠিক তেমনি প্রকৃতপক্ষে অর্পিত সম্পত্তি নয় এমন কোনো সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হলেও ১২০ দিনের মধ্যে কমিটি বা ট্রাইব্যুনালে আবেদন না করলে ওই সম্পত্তির মালিক সাধারণ আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকেও বঞ্চিত হবেন। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে যেসব সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে, সাধারণ জনগণ সেই সব সুযোগ-সুবিধা সাধারণ আইনে অনেক আগে থেকেই ভোগ করে আসছিল। কিন্তু সাধারণ আদালতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রায় সব ক্ষেত্রেই রায় বাস্তবায়িত হতো না। কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয় মর্মে ঘোষণা অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হতে অবমুক্তির ডিক্রি, স্বত্বের ঘোষণা, লিজ প্রদান বেআইনি ঘোষণা প্রভৃতি মামলা হরহামেশাই হয়ে থাকে এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেওয়ানি মামলায় ডিক্রিও হয়ে থাকে। নতুন আইনের কারণে সাধারণ মানুষ আইনের আশ্রয় লাভের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় গেজেট প্রকাশিত হলেই সেই সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে, যা দেশের উচ্চতর আদালতের অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তেরও পরিপন্থী। কারণ, ইতিমধ্যে উচ্চতর আদালতে অনেক রায়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ১৯৬৪-৬৫ সালের শুমারি তালিকায় নেই এমন কোনো সম্পত্তি নতুনভাবে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা বেআইনি। অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন অনুসারে ১১ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখের পর ৩০০ দিনের মধ্যে সরকার যেসব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত করবে, সেই সব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে। তালিকা প্রস্তুতের কাজটি সরকারের নিম্নপদস্থ কর্মচারীদের দ্বারা করা হয়ে থাকে, যাঁদের কোনো জবাবদিহি নেই। কোন সম্পত্তি কী কারণে অর্পিত সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করা হলো, ১৯৬৪-৬৫ সালের তালিকায় আছে কি না, এমনকি কোনো আদালতের চূড়ান্ত রায়ে কোনো সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয় এমন ডিক্রি থাকলেও সেই সব সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত হয়েছে। তহশিলদার (বর্তমানে ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তা) অননুমোদিতভাবে কোনো বাংলাদেশির সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হিসেবে প্রেরণ করলে তা-ই অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে। গেজেটে দেখা গেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন তারিখে অর্পিত সম্পত্তি ভুক্ত করা হয়েছে, কোন কেসের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তির ঘোষণা হয়েছে, তার কোনো কিছুই গেজেটে অন্তর্ভুক্ত নেই। তহশিলদারদের খামখেয়ালিপনা বা স্বেচ্ছাচারিতার জন্য আইনে শাস্তির কোনো বিধান রাখা হয়নি। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ বেশির ভাগ অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত হওয়ায় আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিকার গ্রহণ তাদের জন্য অসম্ভব। আইন সংশোধন করে ৩০ দিন বর্ধিত করা না হলে ২ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনের সুবিধা লাভ করতে পারত। সময় বর্ধিত হওয়ায় সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ মানুষ এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে। কারণ, যিনি স্বপ্নেও কোনো দিন ধারণা করেননি যে তাঁর সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে তেমন অনেক ব্যক্তির সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় আসা অতিসাধারণ ব্যাপার এবং এমন ব্যক্তি অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের সুযোগ গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন না। কারণ, তিনি গেজেটে কী আছে, তা অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন না। যাঁদের দেওয়ানি মামলা-মোকদ্দমা আপিল পর্যায়ে আছে, তাঁদের আপিল মামলাগুলোর কী হবে, তা-ও আইনে উল্লেখ নেই। উত্তরাধিকারী স্বার্থাধিকারী সংজ্ঞা আইনে নেই, ক তফসিলভুক্ত ও খ তফসিল সম্পত্তি পৃথক্করণ অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য। সর্বোপরি বিনিময় সূত্রে মালিক যাঁরা তৎকালীন সময়ে অনেকে অরেজিস্ট্রিকৃত বিনিময় দলিল করেছেন, অনেকে ভারতে আমমোক্তারনামা করেছেন, যাঁরা মূল মালিক ভারতে যাওয়ার আগেই তাঁদের কাছ থেকে সম্পত্তি ক্রয় করেছেন, তাঁরা সম্পত্তি প্রত্যর্পণের সুযোগ পাবেন কি না, তা-ও আইনে অস্পষ্ট। এমন অস্পষ্টতা দুর্বোধ্যতার সুযোগে অর্পিত সম্পত্তির বিষয়ে নতুন জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এরূপ অবস্থায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ভুক্তভোগীদের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করেছে সামান্যই, কিন্তু দুর্ভোগ ও অসুবিধা সৃষ্টির আশঙ্কা, এমনকি অধিকার বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতি দ্রুততার সঙ্গে তালিকা প্রকাশ করায় গেজেটে অসংখ্য ভুলভ্রান্তির কথা বাদ দিলেও জনভোগান্তির কথা ছেড়ে দেওয়ার মতো নয়। সব মিলিয়ে নতুন আইনটির ভালো দিকের চেয়ে মন্দের দিক বহুমাত্রিক। এই আইনের অধীন যে বিধিমালা করা হয়েছে, তা-ও অসম্পূর্ণ। আইনটি হওয়া উচিত কল্যাণকর ও যুগোপযোগী।
লেখক  আইনজীবী, জেলা আইনজীবী সমিতি, পঞ্চগড়।

No comments

Powered by Blogger.