চাঁপাইনবাবগঞ্জে এত আম, তবু রপ্তানি নেই by শহীদুল হুদা অলক

প্রাচীনকাল থেকেই যে আম দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে চেনা যায়, সেই জেলাটির 'আম অর্থনীতি' এখন বেশ চাঙ্গা। প্রতিদিন ছয় কোটি থেকে সাত কোটি টাকার আম বেচাকেনা হচ্ছে জেলার আম বাজারগুলোয়। সেই হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে, চলতি মৌসুমে আমের ব্যবসা হচ্ছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।


তবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেন শুধুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নানা সমস্যা ও জটিলতায় বিদেশের বাজারে জায়গা করতে পারছে না চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম। আম নিয়ে গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মাঝে মধ্যে রপ্তানির সম্ভাবনার কথা বললেও তা আলোর মুখ দেখছে না।
মাটি, আবহাওয়া ও প্রকৃতিগত কারণেই সুস্বাদু ও রসালো আম উৎপাদনের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের খ্যাতি অনেক আগে থেকেই। দেশ বিভাগের আগে এই খ্যাতি মালদহ জেলার নামে উচ্চারিত হলেও পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ তার স্থান ফিরে পায়। দেশের মোট আম উৎপাদনের সিংহভাগই হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আর জাত বিবেচনায় উন্নত জাতের ৮০ শতাংশই চাঁপাইনবাবগঞ্জের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, আম উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় জেলার কৃষকরাও আম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আদিকাল থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে প্রচুর আম বাগান থাকলেও বিগত দেড় দশকে আম বাগান বৃদ্ধি পেয়েছে রেকর্ড পরিমাণে। মাত্র আট বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেখানে আমের বাগান ছিল ১৬ হাজার হেক্টর, সেখানে এখন তা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার হেক্টরে। এর মধ্যে বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর বাগান গড়ে উঠেছে। জেলার প্রায় ১৮ লাখ আম গাছ থেকে সাম্প্রতিককালে বছরে প্রায় দুই লাখ মেট্রিক টনের বেশি আম উৎপাদিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমের মাঝখানে খরা আর অনাবৃষ্টির কারণে আম উৎপাদন ব্যাহত হলেও এ বছর আম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার টন। জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আহমেদ ইকবাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মৌসুমের শুরুতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়া আম উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী ছিল। সে সময় মুকুলও এসেছিল প্রচুর। কিন্তু মাঝখানে বিরূপ আবহাওয়া ক্ষতি করলেও তা ব্যাপক নয়। এখনো ফজলি, আশ্বিনী প্রচুর পরিমাণ রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন না পেলেও কাছাকাছি ফলন পাওয়া যাবে।'
কানসাট আম বাজার, সদরঘাট আম বাজার, রহনপুর রেলস্টেশন আম বাজার, ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশন বাজারসহ জেলার ছোট-বড় প্রায় ৩৫টি আম বাজারে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার আম বেচাকেনা হচ্ছে। বাজার সূত্রগুলো জানিয়েছে, এসব বাজারে প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় কোটি থেকে সাত কোটি টাকার আম বেচাকেনা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে উৎপাদিত আমের প্রায় পুরোটাই বেচাকেনা দেশীয় বাজারে সীমাবদ্ধ থাকছে বছরের পর বছর। আম প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার আম পচে নষ্টও হচ্ছে। আম ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রক্রিয়াজাতকরণসহ রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হলে আম থেকে কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক অর্থ আয় করা সম্ভব। তা না হওয়ায় তাঁরা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করছেন। শহরের আম ব্যবসায়ী আবদুল হান্নান বলেন, '৩০-৩৫ লাখ টাকা দিয়ে আম বাগান কিনে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর দেশীয় বাজারে দর ওঠানামা নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। কোনো বছর কিছুটা লাভ পাওয়া গেলেও বেশির ভাগ বছরগুলোয় তেমন লাভ আসে না। আর লোকসানে পড়ার ঘটনা তো রয়েছে।' তিনি বলেন, 'রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি হলে ব্যবসায়ীদের ন্যায্যমূল্য পাওয়াটা অনেকাংশে নিশ্চিত হতো।'
১৯৮৫ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৯০ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়া আম গবেষণাকেন্দ্রটির পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ দুই যুগেও প্রতিষ্ঠানটি পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। কেন্দ্রটি দীর্ঘ এ সময়ে আটটি নতুন জাত উদ্ভাবন করতে পারলেও বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্যিক দিকের প্রতি কোনো গুরুত্ব নেই গবেষণাকেন্দ্রের। তিনি জানান, বিদেশে আম রপ্তানি করতে হলে তাঁদের কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হবে। যার মধ্যে রয়েছে- আমে কোনো দাগ থাকা চলবে না, রং ভালো হতে হবে, কম মিষ্টি হলে চলবে না, রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না। বিদেশে বাজার সৃষ্টির জন্য এই শর্তগুলো বিবেচনা করার জন্য যে আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করা দরকার তা তেমন হচ্ছে না। গবেষণাকেন্দ্রের উদ্ভাবিত বারী-২ (লক্ষ্মণভোগ) কালার্ড করতে পারলে বিদেশে বাজার সৃষ্টি করা যেত। কিন্তু সেটাও হচ্ছে না। গবেষণাকেন্দ্রের সূত্র জানায়, নানামুখী জটিলতা ও জনবলের অভাবের কারণে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যাওয়া যাচ্ছে না। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের জন্য 'প্রদর্শনী প্লট' করে আমের চাষ করলে একটা সফলতা আসা সম্ভব। এ ব্যাপারে উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে কিছু আম গেলেও বাণিজ্যিকভাবে আম রপ্তানি শুরু হয়নি। আম রপ্তানি না হওয়ার জন্য তিনি দায়ী করেন চাষিদের রাসায়নিক ব্যবহারকে। তিনি বলেন, কীটনাশক ব্যবহার ও প্যাকেজিং দুর্বলতার কারণে বিদেশে বাজার সৃষ্টি হয়নি। রপ্তানি নিয়ে যে কাজ হচ্ছে তা সীমিত পর্যায়ে। তিনি জানান, হাবার্ট ফাউন্ডেশন নামের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান রপ্তানি সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করে।
আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, আমের উদ্ভাবন নিয়ে সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করলেও তাঁরা রপ্তানি সম্ভাবনা সৃষ্টি নিয়ে কাজ করছে না। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করে তাঁরা জানান, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা যে পরামর্শ দেন, সে মোতাবেক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আম পাড়ার পর তা বেশি সময় সংরক্ষণের জন্য কেমিক্যাল ব্যবহার করে। আম ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম অভিযোগ করেন, বিদেশিদের আস্থা অর্জনের জন্য আম গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দুই-তিন হাজার হেক্টর আম বাগান নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে রপ্তানি উপযোগী করে চাষ করলে রপ্তানি সুযোগ সৃষ্টি হয়। সেদিকে নজর নেই কারোই।

No comments

Powered by Blogger.