ষড়রিপুর প্রবঞ্চনা থেকে মুক্ত থাকার নাম সিয়া by সৈয়দ গোলাম মোরশেদ

'হে ইমানদারগণ, তোমাদের ওপর সিয়াম (রোজা) ফরজ করা হলো, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পারো' (২:১৮৩)। উপর্যুক্ত আয়াতে ইমানদারদের ওপর সিয়াম সাধনা ফরজ করার উদ্দেশ্যের কথা আল্লাহ ব্যক্ত করেছেন।


ওই আয়াতে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে 'তাকওয়া' অর্জন করাই হচ্ছে মুমিনের প্রধান লক্ষ্য। শুধু এক মাসের অনুশীলনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে 'মুত্তাকি' হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং মুত্তাকি হতে হলে সিয়ামের দর্শন, আদর্শ, অনুশীলন জীবনব্যাপী হতে হবে এবং এটাই পবিত্র কোরআনের দাবি।
যিনি তাকওয়া অর্জন করেছেন, পবিত্র কোরআনের ভাষায় তাঁকে মুত্তাকি বলা হয়। দুনিয়ার যাবতীয় বিষয়বস্তু থেকে মুখ বা মনকে ফিরিয়ে আপন প্রভুর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার নাম হচ্ছে তাকওয়া। মুত্তাকি ব্যক্তি দুনিয়ার কলুষ থেকে মুক্ত। কোনো বিষয়বস্তুর আকর্ষণ তাঁকে মোহমুগ্ধ করে রাখতে পারে না। তাকওয়াকে 'আল্লাহর ভূষণ' বলা হয়েছে। আল্লাহর গুণাবলিই সাধকের কাছে 'আল্লাহর ভূষণ'। আল্লাহ যেমন বে-নেওয়াজ অর্থাৎ কারো মুখাপেক্ষী নন, তেমনি আল্লাহর বান্দা মুত্তাকিও আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো মুখাপেক্ষী নন। বস্তুর আকর্ষণ, মোহ, মায়া, ভোগ ইত্যাদির মোহবন্ধন থেকে আত্মাকে ফিরিয়ে এনে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মহান আত্মসাধনাকে সিয়াম বলে।
আল্লাহ তায়ালা মানুষের এ প্রবৃত্তিগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করেছেন। যেমন- নফসে আম্মারা তথা ষড়রিপুর বশবর্তী আত্মা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য হচ্ছে নফসে আম্মারার বাহন। 'কাম'- হচ্ছে নারী-পুরুষের কদর্য ব্যভিচার। নারী-পুরুষের অবাধ ও অবৈধ যৌনাচারকে বোঝানো হয়েছে। 'ক্রোধ'- রাগ, ফলে মারামারি, খুন-জখম ইত্যাদি। 'লোভ'- প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাওয়া ও পাওয়ার জন্য যেকোনো অপরাধ সংঘটিত করা। 'মোহ'- সংসার ধর্ম পালন করতে গিয়ে স্ত্রী-পুত্র, ধন-সম্পদের মোহাবরণে আবদ্ধ হয়ে পড়া। 'মদ'- অহংকার, অহেতুক দেমাগ, গর্ববোধ করা, সম্মানের প্রতি লালায়িত হয়ে পড়া ইত্যাদি। 'মাৎসর্য'- পরশ্রীকাতরতা, ভালো দেখতে না পারা, অপরের ক্ষতি করা ইত্যাদি। বিষয়বস্তু কখনো কলুষিত নয় বরং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। নফসে আম্মারা যখন মোহাবিষ্ট হয়ে কোনো বিষয়বস্তু বা ব্যক্তিকে গ্রহণ করে বা ধারণ করে তখনই সে বস্তু বা ব্যক্তি তাগুত হয়ে যায়। যার ওপর সে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আল্লাহপাক তাই পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন, আপনি কি তাকে দেখেছেন যে স্বীয় প্রবৃত্তিকে তার মাবুদ বা খোদা বলে সাব্যস্ত করেছে? (সুরা জাসিয়া : ২৩)।
ষড়রিপুর মাধ্যমে শয়তান মানব অন্তরে প্রবেশ করার সুযোগ পায় এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে মুখ ফিরিয়ে দুনিয়ামুখী করে তোলে। শয়তান কোনো দেহধারী জীব নয়। শয়তান যাতে মানুষের অন্তরে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য সিয়াম সাধনা দিয়ে নফসের প্রবেশ দ্বারে তাকওয়ার পাহারা বসাতে হয়। এ পাহারা জীবনব্যাপী রাখতে পারলে তবেই তাকওয়া অর্জিত হয়। পবিত্র হাদিস শরিফে উল্লেখ আছে, 'রমজান মাসে আকাশের দরজা (জান্নাতের) খুলে দেওয়া হয়, দোজখের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং শয়তানকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রাখা হয়।' এখানে কথাগুলো রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। শয়তান যদি কোনো দেহধারী জীব হতো তাহলে তাকে বন্দি করে রাখার ফলে পৃথিবীতে কোনো পাপ ও অসৎকার্য সংঘটিত হওয়ার কথা নয়। এখানে সিয়ামের কঠোর কৃচ্ছ্র ও আত্মশুদ্ধির সাধনার ফলে মুমিনের মনে নফসে আম্মারা তথা ষড়রিপু বেশে শয়তান প্রবেশ করতে পারে না। ফলে মুমিন ব্যক্তি মাগফিরাতের বিনিময়ে পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করিয়ে আল্লাহর বিশেষ রহমতপ্রাপ্ত হয়ে জান্নাতের উপযোগী হিসেবে নিজেকে গড়ে নিতে সক্ষম হয়।
নফসে লাওয়ামা : আত্মশুদ্ধির এ স্তরকে পবিত্র কোরআনে নফসে লাওয়ামা বা অনুতাপশীল আত্মা বলা হয়েছে। এ স্তরের আত্মাকে সাধক আত্মাও বলা হয়। এসব আত্মা তাদের পূর্ববর্তী গুনাহগুলো থেকে আল্লাহর দরবারে মাগফিরাত কামনা করে এবং ইবাদত-বন্দেগি ও সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর রেজামন্দি তথা সন্তুষ্টি অর্জনে সদাসর্বদা সাধনায় রত থাকে। পবিত্র কোরআনের সব আদেশ-নিষেধ, দিকনির্দেশনা তাদের উদ্দেশ্যেই দেওয়া হয়েছে। আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে সুরা কিয়ামতে এ অনুতপ্তশীল আত্মার কসম খেয়েছেন। এ রকম সাধক আত্মা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়।
নফসে মৎমায়িন্না : এ আত্মা হচ্ছে পরিশুদ্ধ আত্মা। নফসে লাওয়ামা আত্মশুদ্ধির একপর্যায়ে আল্লাহর রেজামন্দি তথা সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হয়। তখন সে তার ইমানের দৃঢ়তা অর্জনে সক্ষম হয় এবং তার দ্বারা আর কোনো পাপকার্য সম্পাদন হয় না। তখন তারা আল্লাহর স্বীকৃত দাসে তথা আবদিয়তের মকামে উপনীত হয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাদের জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন। ইরশাদ হচ্ছে- হে নফসে মুৎমায়িন্না (শুদ্ধি, শান্তি ও পরিশুদ্ধ আত্মা), তুমি তোমার প্রভুর পানে ফিরে এসো, তিনি তোমার ওপর সন্তুষ্ট এবং তুমিও তাঁর ওপর সন্তুষ্ট। অতএব, আমার খাস বান্দার মধ্যে তুমি শামিল হও, আর আমার জান্নাতে প্রবেশ করো (জীবিত অথবা মৃত অবস্থায়)।
নফসে মুলহেমা : 'অন্নাফসে অমা ছাওয়াহা' (৯১:৭) আর ওই আত্মা যাকে (আমি) সুশোভন করি। অর্থাৎ নফসে আম্মারা (ষড়রিপুর আত্মা) থেকে নফসে লাওয়ামায় (অনুতাপশীল ও সাধক আত্মা) উপনীত হওয়ার পর কঠোর ইবাদত-বন্দেগি, কৃচ্ছ্র সাধন, আত্মশুদ্ধি বদান্যতার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ফলে নফসে মুৎমায়িন্নাপ্রাপ্ত হয়ে একজন ব্যক্তি আল্লাহর জান্নাতে প্রবেশাধিকার প্রাপ্ত হন এবং আল্লাহর খাস বান্দা, প্রিয় বান্দা অলি গাউস কুতুবে উপনীত হতে সক্ষম হন। তখন আত্মা আল্লাহর পক্ষ থেকে পাপ-পুণ্যের এলহাম প্রাপ্ত হয়। আর আত্মার অধিকারী ব্যক্তি রহমানির রাহিম প্রভু থেকে প্রতিনিয়ত এলহামপ্রাপ্ত হয়ে হিদায়াতের দিক নির্দেশনাপ্রাপ্ত হন। অর্থাৎ তখন তিনি হাদি হিসেবে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে হিদায়াতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তাঁরাই এ পৃথিবীর বুকে গাউস, কুতুব ও অলি-আল্লাহরূপে আবির্ভূত হন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.