সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ-রাজনীতি কোন পথে? by এমাজউদ্দীন আহমদ

ব্যক্তিগত বুদ্ধি যতই প্রখর হোক না কেন, সামষ্টিক প্রজ্ঞা অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি কার্যকর, অনেক বেশি ফলপ্রসূ, এই সত্য তাদের অনুধাবন করতে হবে। তখনই তারা জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণে সক্ষম হবেন।


একবার ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি গেলে, দূর অতীত এবং পোড় খাওয়া বর্তমান তাদের কাছে গৌণ হয়ে উঠবে। তখনই তারা যোগ্যতর ভূমিকার জন্য তৈরি হতে পারবেন

বাংলাদেশের রাজনীতি আজ যে পথে পা বাড়িয়েছে সে পথ দুর্গম। সে পথ অগম্য। সে পথ ভয়ঙ্কর উত্তপ্ত। মনে হয়, অনেকটা জেনেশুনেই দেশের রাজনীতিকরা রয়েছেন কণ্টকাকীর্ণ এই পথে। কেন, কিসের লোভে, কোন উদ্দেশ্যে তারা এ পথে পা বাড়িয়েছেন তা তারাই ভালো জানেন। কিন্তু যে জন্য রাজনীতি এবং যাদের জন্য রাজনীতি এবং যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজনীতির জন্ম, তা যে এ পথে অর্জিত হওয়া সম্ভব নয় তা সবাই জানেন। সব বুঝে-শুনে বাংলাদেশ রাজনীতির কুশীলবরা এ পথে চলেছেন। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে। তত্ত্বগত দিক থেকে তা ঠিক বটে; কিন্তু অবিশ্বাস্য মনে হয় এই ভেবে যে, একজন রাজনৈতিক নেতা অন্যজনকে এতটুকু বিশ্বাস করেন না। এক দল অন্য দলের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থা রাখে না। রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে দেশের দুটি বৃহৎ দলের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অনাস্থার তাপে রাজনীতির সৌকর্য এ দেশে প্রতিনিয়ত ঝলসে যাচ্ছে। সংঘাতের পথ প্রশস্ত হয়েছে। নির্মম হানাহানির মুখ ব্যাদানে জাতীয় অর্জনের বিরাট অংশ যেতে বসেছে। এ অবস্থা অনাকাঙ্ক্ষিত। অবাঞ্ছিত।
বহুবার বলেছি, জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ জয়যাত্রা শুরু করে গণতন্ত্রের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। এ জাতি তা ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। মাত্র আড়াই-তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র হয় নির্বাসিত। জনপ্রতিনিধিত্বের মর্যাদা হয়ে ওঠে ধূলি-ধূসরিত। মানবাধিকার হয় ভূলুণ্ঠিত। অগণতান্ত্রিকতার ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় দেশটি। দীর্ঘ দেড় দশকের সংগ্রাম-অভিযান এবং ত্যাগ-তিতিক্ষার পর নতুনভাবে এ দেশে গণতন্ত্রের নতুন সূর্যোদয় হয়, সব দল ও মতের ঐকমত্যের বিস্তৃত মোহনায়। পথহারা পথিক একবার যদি সেই পথের সন্ধান পায়, সবাই বিশ্বাস করেন, তাহলে সেসব কিছু হারাতে পারে, কিন্তু আর হারায় না সেই পথ। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা পর্যালোচনা করে আমরাও সেই বিশ্বাসে ছিলাম বলীয়ান। প্রতিদিনের দলীয় কর্মকাণ্ডের নিরিখে কিন্তু জাতি এখন অনেকটা হতাশাগ্রস্ত। যে জনগণের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থকে প্রতিনিয়ত লালন করে চলেছে সেই জনগণও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উচ্চকণ্ঠকে দেখছেন গভীর সন্দেহের চোখে। প্রত্যেকের মনে প্রশ্ন :দশম জাতীয় সংসদের জন্য নির্ধারিত নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত না হয় তাহলে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য? কোথায় গিয়ে, কোন বালুচরে ধাক্কা খাবে আমাদের জাতীয় জাহাজ? কোন অন্ধকার গহ্বরে প্রবেশ করবে জনগণের সুখস্বপ্নগুলো?
এর মধ্যে বহু বালুচর সৃষ্টি হয়ে গেছে অথবা বলব সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টি করেছেন আমাদের কৃতী রাজনীতিকরা। মাত্র দুটি উল্লেখ করতে চাই। এক. বাংলাদেশে সংবিধানের ৭২(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে_ 'রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।' সংসদীয় ব্যবস্থায় এইটিই নিয়ম, কিন্তু সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে লিখিত হয়েছে_ সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে_
ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার নব্বই দিনের পূর্বে। অন্য কথায়, জাতীয় সংসদ সংগঠনের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার সার্বিক প্রভাব ও প্রতিপত্তির ছড়ি ঘোরাতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীরূপে, সংসদের এবং দলের নেতা হিসেবে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে। মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে সকল সুযোগ-সুবিধাসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন প্রথাগতভাবে বলতে থাকবেন, বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো; দুর্নীতি দমন কমিশন কালো টাকাকে নিজের স্পর্শে সাদা বলে ঘোষণা দিতে থাকবেন; যখন রাষ্ট্রের কৃত্যকরা দলীয় আনুগত্যের কারণে বলবেন সব কিছু ঠিক আছে; যখন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলো নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জিহাদে পূর্ণ শক্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করবে। সবারই স্মরণ থাকার কথা, যখন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হচ্ছিল তখন গণপরিষদের মাননীয় সদস্যগণ ব্রিটিশ মডেলের সংসদীয় ব্যবস্থার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন এবং তাকিয়ে ছিলেন মহান প্রতিবেশী ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থার দিকে। কিন্তু ব্রিটেনের কমন্স সভার নির্বাচন কখন হয়, কীভাবে হয়? কমন্স সভার কার্যকালে কি? ভারতের লোকসভার নির্বাচন কখন হয়, কীভাবে হয়? লোকসভার কার্যকালের মধ্যে? না পরে? যে কোনো বিবেকবান ব্যক্তি বাংলাদেশের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদকে কীভাবে গ্রহণ করবেন? রাজনৈতিক দলগুলোর এ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? অন্য কোনো রাজনৈতিক দল যে এই ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না তা তো নিশ্চিত। তাহলে কি আমরা আবারও বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগে ফিরে যাচ্ছি? অন্য কোনো রাজনৈতিক দল সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে যদি ক্ষমতাসীনরা নির্বাচন করতে দৃঢ়সংকল্প হয় তাহলে এর পরিণতি কী হবে? আমরা সবাই জানি, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো গণতন্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু সংসদের কার্যকাল সমাপ্ত হওয়ার আগে অথবা তা ভেঙে না দেওয়ার আগে ক্ষমতাসীন দল যদি ক্ষমতায় থেকে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করে তাহলে তাকে কী বলবেন? ১৯৭৫ সালের বাকশালকে সমর্থন করে এখনও কেউ কেউ বলে থাকেন, এটি ছিল সব দলের একটা প্লাটফর্ম। গণতন্ত্রে কি এমন প্লাটফর্মের প্রয়োজন রয়েছে? সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি প্লাটফর্মের প্রয়োজন রয়েছে কি? সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি প্লাটফর্ম যদি এতই প্রয়োজন তবে হিটলারের নাৎসি দল বা মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট দলকে আমরা এত ঘৃণা করি কেন? সংসদীয় গণতন্ত্রের লেবাসে ফ্যাসিবাদ বা নাৎসিবাদ শুধু আত্মপ্রবঞ্চনা নয়, এটি জাতীয় প্রবঞ্চনা বটে। এটি অগ্রহণযোগ্য। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। এটি অগণতান্ত্রিক। এটি অনৈতিক। বিশ্বের কোথাও এমন ব্যবস্থা নেই। এর মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব নয়।
দুই. যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে বিলুপ্ত হয়েছে তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অথবা জাতীয় সরকার অথবা নির্বাচন পরিচালনা পরিষদ অথবা অন্য যে কোনো নামে ফিরিয়ে আনা একান্ত প্রয়োজন। দেশে বর্তমানে যে দুটি রাজনৈতিক জোট বিদ্যমান, তাদের পারস্পরিক বিদ্বেষ, অনাস্থা, অবিশ্বাস এমন এক পর্যায়ে পেঁৗছেছে যে, সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে সৃষ্টি করতে হবে এমন এক ব্যবস্থা, যা নিরপেক্ষতার প্রতীক অথবা পক্ষপাতহীন এক ব্যবস্থা। প্রথমে এ দাবি ছিল শুধু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের। এখন এ দাবি জনতার। বিশিষ্টজনদের। বুদ্ধিজীবী মহলের। সব গণতন্ত্রমনা ব্যক্তির। এই দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচন করলে তা হবে এক প্রহসন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে। এরও কারণ আছে। যে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে তাদের নির্ভর করতে হবে দেশের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওপর এবং তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ হলো দলীয়করণের ফসল। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্বাভাবিক এবং এ বাহিনীতেও রয়েছে বিশেষ এলাকার, বিশেষ দলের উল্লেখযোগ্য দলীয় কর্মী। কালো টাকার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পূর্ণ অপারগ। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নিজেই বলেছেন, দেশে আইনের শাসন নেই এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে অহরহ।
কখন আমাদের রাজনীতিকরা সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তার কালো কুঠুরি থেকে বেরিয়ে বৃহত্তর জনকল্যাণের মহাসমুদ্রে মিশে যাবেন সবার সঙ্গে? এমনটি তো ঘটেছে পাশ্চাত্যের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে তারা গ্রহণ করতে শিখেছেন জনগণের আমানতরূপে। নিজেদের প্রভাব বা বৈভবের মাধ্যম হিসেবে না দেখে রাজনৈতিক ক্ষমতা হয়েছে তাদের কাছে জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থের মাধ্যম মাত্র। তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন মিলেমিশে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগ তাদের কাছে হয়ে পড়েছে এক বিরাট দায়িত্ব, কোনো অধিকার বা প্রিভিলেজড অবস্থান নয়। আমাদের রাজনীতিকদের কাছে তা এক রত্নভাণ্ডারের মতো। ভীষণভাবে উপভোগ্য। মহামূল্যবান সম্পদের মতো। তাই সবাই এতে ভাগ বসাতে চান। এ এক পরম কাঙ্ক্ষিত সুযোগ, যা শুধু ব্যক্তির নয়; পরিবার, গোষ্ঠীর এমনকি দলেরও ভাগ্য পাল্টে দিতে পারে। তাই এর আবেদন রাজনীতিক তথা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এত গভীর। এ সুযোগ হাতে পেতে তাই রাজনীতিকদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। মান-সম্মান, ন্যায়বোধ-নৈতিকতা, বৈধ-অবৈধ, গ্রহণযোগ্য-অগ্রহণযোগ্য নির্বিচারে সেই কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র ক্ষমতার দিকে ছুটে চলেন আমাদের রাজনীতিকরা। তাকে আয়ত্তে পেতেই হবে, যে কোনো পন্থায় হোক না কেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, এ দেশের কিছু বুদ্ধিজীবীও এসব বিষয়ে হয়তো নির্বিকার, না হয় রাজনৈতিক দলের ফেলো_ ট্রাভেলর হিসেবে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিকদের সেই উদ্যোগে সায় দিয়ে থাকেন। সত্য কথনে তাদের দ্বিধা। প্রতিবাদে তাদের অনীহা। বরং সর্বক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রয়েছেন তারা। কারণও অবশ্য সুস্পষ্ট। পছন্দের দল ক্ষমতাসীন হলে তারাও মাঝে মধ্যে ক্ষমতার করিডোরে ঘুরেফিরে ক্ষমতার উষ্ণতা অনুভব করতে পারেন। ফলে বাংলাদেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের লড়াইটা খুব জমজমাট এবং এটিকেই এ দেশের রাজনীতি বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। যারা ক্ষমতাসীন তারা প্রাণপণে আঁকড়ে থাকেন এই দুর্মূল্য সামগ্রীটিকে।
এমনি অবস্থায় দশম সংসদের জন্য সাধারণ নির্বাচন আসছে। তাই রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নতুনভাবে উত্তপ্ত হয়েছে। এ তাপে দেশের দুর্বল অর্থনীতি যে ঝলসে যেতে পারে সেদিকে কারও নজর নেই। এই তাপে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যে জ্বলে-পুড়ে খাক হতে পারে তাও কারও দৃষ্টিতে নেই। প্রতিনিয়ত জনজীবন যে পর্যুদস্ত হচ্ছে তা কে ভাববে? যাতায়াত এবং পরিবহনের দুর্ভোগে সামাজিক জীবন যে ক্ষতবিক্ষত তাইবা দেখবে কে? রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে রাষ্ট্রক্ষমতার সোনার হরিণটি চাই। তা যেভাবেই হোক। সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে হলে ভালো, তা না হলে যে কোনো অবস্থায় এবং সব কিছুই দেশের ভাগ্যপীড়িত জনগণের নামে। যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার সময় দেশব্যাপী আন্দোলনের ঝড়ে চারদিক লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়েছিল, আজকে সেই ব্যবস্থার সংস্কারের নামে আবারও ঝড় উঠেছে। হরতাল-অবরোধের তরঙ্গে সব কিছু ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ক্ষমতাসীনরাও যেমন আকাশছোঁয়া অহমিকায় স্ফীত, বিরোধী দলগুলোও তেমনি তীব্র অহংবোধের প্রচণ্ড দাপটে মারমুখী। লক্ষ্য সবার একটাই এবং তাহলো রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের চাই। গণতন্ত্রের কথা সবাই বলছেন, কিন্তু গণতন্ত্রের মূলকথা যে মিলেমিশে কাজ করা, আলাপচারিতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান, পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ঐকমত্য গঠন, বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াকে মুখ্য জ্ঞান করা_ তা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এর পরিণতি কখনও শুভ হয় না। রাজনৈতিক নেতাদের একগুঁয়েমির ছিদ্রপথে অশুভ শক্তি মাথা উঁচু করতে পারে, তা দেশীয় হোক আর বিদেশি। মাতব্বরের আদলে অনেক মহল 'ত্রাণকর্তা' হয়ে উঠে আসতে পারে। প্রথমে উপদেশের ডালা সাজিয়ে সামনে আসবে। পরে নির্দেশ দেওয়ার ঔদ্ধত্য নিয়ে হাজির হতে পারে। এ দেশের ইতিহাসে মীরজাফরের অস্তিত্ব যেমন সত্য, তেমনি সত্য ক্লাইভ ও ডুপ্লের কারসাজিও।
কেন জানি না, আমরা অত্যন্ত বেশি অতীতমুখী। অতীতের মহান অর্জনকে নিয়েই যত বিতর্ক, বিশেষ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে। এও আমরা সবাই জানি, মুক্তিযুদ্ধ ছিল সবার। সমগ্র জাতির যুদ্ধ। সবাই কম-বেশি তাতে অংশীদার ছিলাম, কিছু বিপথগামী, রাজাকার, আলবদর ছাড়া। কোনো নেতার ডাকে, আত্মদানের জন্য, সবাই যুদ্ধ ক্ষেত্রে সমবেত হননি। জাতীয় চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়েই, কোনো ক্ষেত্রে নিজ পরিবার, নিজ এলাকা অথবা বৃহত্তর পরিসরে নিজের লোকজনের সম্মান বাঁচাতেই তারা যুদ্ধে যোগদান করেন, দেশের সুসন্তানরূপে। আমাদের নেতারা কিন্তু বর্তমানের সংগ্রামে অতীতের অর্জনকেই নিজেদের অর্জনরূপে দাবি করেন প্রধান মূলধন রূপে, অযোগ্য সন্তানরা যেমন পৈতৃক সম্পদকে দাবি করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধায়। বর্তমানকে আরও প্রাণবন্ত করা অথবা ভবিষ্যৎকে আরও উজ্জ্বল করার স্বপ্ন বিবর্জিত আমাদের নেতারা তাই অতীতে বসবাস করাটাকেই অধিক নিরাপদ মনে করেন। শুধু তাই নয়, তারা শুধু মাটিতেই বসবাস করতে আগ্রহী। অসমতল ভূমিতে, ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে, প্রতি পদে কর্দমাক্ত হয়ে অথবা সবাই মিলেমিশে ধূলি-ধূসরিত হয়ে, জড়াজড়ি করে বাঁচতে ভালোবাসেন। মাটিতে পা রেখে আকাশ দর্শনেও নেই তাদের কোনো আগ্রহ। আকাশে উঠে, মাত্র কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে উঠে, চোখ নিচু করলে এই মাটি যে কত সুন্দর দেখায় সেই চমৎকার অভিজ্ঞতাও তাদের নেই। তাই সর্বত্র দেখছেন শুধু অসুন্দর, শ্রীহীন, আবিলতাপূর্ণ। আমাদের রাজনীতিকদের এ অসম্পূর্ণতাকে কাটিয়ে উঠতে হবে। মাটিকে ভালোবাসতে হবে ঠিকই, কিন্তু ওপর থেকে এ মাটিকে দেখার চোখও আবিষ্কার করতে হবে। অতীতকে সবার সম্পদরূপে গ্রহণ করে বর্তমানকে মুখ্য জ্ঞান করতে হবে। ব্যক্তিগত বুদ্ধি যতই প্রখর হোক না কেন, সামষ্টিক প্রজ্ঞা অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি কার্যকর, অনেক বেশি ফলপ্রসূ, এই সত্য তাদের অনুধাবন করতে হবে। তখনই তারা জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ সঠিকভাবে সংরক্ষণে সক্ষম হবেন। একবার ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি গেলে, দূর অতীত এবং পোড় খাওয়া বর্তমান তাদের কাছে গৌণ হয়ে উঠবে। তখনই তারা যোগ্যতর ভূমিকার জন্য তৈরি হতে পারবেন। এ দেশের জনগণ যারা দেশের অসুস্থ রাজনীতির কাছে অসহায় জিম্মি হয়ে রয়েছেন তারা সেই আশায় বুক বেঁধেছেন।

এমাজউদ্দীন আহমদ :সাবেক উপাচার্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

No comments

Powered by Blogger.