যশোরে ৮০ দিনে ৩৭ খুন by মনিরুল ইসলাম

যশোরে আশঙ্কাজনকভাবে খুনের ঘটনা বেড়েছে। জেলায় ৮০ দিনে ৩৭ জন খুন হয়েছে। এর মধ্যে দুজন স্কুলছাত্র। চোরাচালানের বিষয়ে প্রতিবেদন করায় দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে এক সাংবাদিককে। এ সময় সন্ত্রাসী হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কয়েকজন নেতা।


খুনের ঘটনা বেড়েছে স্বীকার করলেও আইনশৃঙ্খলার অবনতির দায় নিতে রাজি নন যশোরের পুলিশ সুপার কামরুল আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিত বা রাজনৈতিক কারণে খুন হলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে বলে ধরা হয়। কিন্তু সম্প্রতি যশোরে যত খুন হয়েছে তার অধিকাংশই ঘটেছে পারিবারিক অশান্তি কিংবা পূর্বশত্রুতার জেরে।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মে মাসের শুরু থেকে জুলাই মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ৩৭ জন খুন হয়েছে। এসব ঘটনায় করা মামলায় অভিযুক্ত ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চারটি মামলায় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় চারজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন হাতে না আসায় একটি মামলারও অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়নি।
চলতি মাসের ১৯ দিনে নয়টি হত্যাকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে গত বৃহস্পতিবার রাতে জেলার অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌরসভা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমানকে (৫৮) সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। এর প্রতিবাদে ও হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে শুক্রবার উপজেলা সদর নওয়াপাড়ায় অর্ধদিবস হরতাল পালন করা হয়।
অপহরণের পর স্কুলছাত্রকে হত্যা: ৯ জুলাই দুপুরে যশোরের চৌগাছা উপজেলার গরীবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সৌরভ সাহা (১০) নামে চতুর্থ শ্রেণীর এক শিশুকে অপহরণ করা হয়। ১১ জুলাই সকালে স্কুলের পাশের পাটখেত থেকে সৌরভের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চৌগাছা থানার উপপরিদর্শক মহসিন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, স্কুলছাত্র সৌরভ সাহাকে অপহরণ ও হত্যা মামলায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে মূল আসামি পিতাম্বরপুর গ্রামের বিল্লাল হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে। বিল্লাল হোসেন স্বীকার করেছেন, পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে তাঁরা ছয়জন সৌরভকে অপহরণ করেন। পরে তাঁরা সৌরভকে খুন করে পাটখেতে ফেলে রাখেন। নিহত সৌরভের বাবা স্বপন সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে গেছে। এখন হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো ছাড়া আমার আর কী-ই বা চাওয়ার আছে।’
একই স্কুলের ছাত্রদের হাতে খুন!: ১৫ জুলাই বিকেলে যশোর শহরের আবদুস সামাদ মেমোরিয়াল একাডেমির মাঠে জাহিদুল ইসলাম আকাশ (১৫) নামের নবম শ্রেণীর ছাত্রকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। আকাশ আবদুস সামাদ মোমোরিয়াল একাডেমির নবম শ্রেণীর মানবিক বিভাগের ছাত্র। তার বাবা সুলতান আহমেদ পুলিশের হাবিলদার। আকাশের মা বিউটি বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার সময় পাঁচজন ধরে আমার ছেলেকে কুপিয়ে মেরে ফেলল। আসামিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ কোনো ভূমিকা নিচ্ছে না। আসামিদের লোকজন হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।’ সন্তানের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানিয়ে বিউটি বেগম বলেন, ‘আমার একটাই চাওয়া, সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।’ যশোর কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মামলার আসামিরা পলাতক। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এ ছাড়া জেলার সদর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের সুলতানপুর গ্রামে সালমা খাতুন (২০) নামে এক গৃহবধূকে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। ৯ জুলাই সকালে ঘরের দরজা ভেঙে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে সালমার স্বামী আবদুল্লাহ তিতুমিরকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। নিহত সালমার বাবা কবির হোসেন অভিযোগ করেন, যৌতুকের টাকা না পেয়ে তিতুমির সালমাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।
১৯ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের যশোর শহরের বারান্দিপাড়ার মান্দারতলা এলাকায় হায়দার আলী শেখ (৪৫) নামের এক ট্রাক চালককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। হায়দারের বাড়ি পিরোজপুর সদর উপজেলার গোয়াবাড়িয়া গ্রামে। তিনি যশোর শহরের বারান্দিপাড়া এলাকায় বসবাস করতেন।
চোরাচালানের প্রতিবেদন করায় সাংবাদিক খুন: গত ১৫ জুন রাত সাড়ে নয়টার দিকে যশোরের শার্শা উপজেলার কাশিপুর বাজারে দৈনিক গ্রামের কাগজ-এর সাংবাদিক জামাল উদ্দীনকে (৪২) নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। জামাল শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের আবদুল আলিমের ছেলে। কাশিপুর গ্রামের তোতা মিয়ার বসতবাড়ির শোবার ঘর থেকে ওই রাতেই পুলিশ রক্ত মাখা ছুরি, একটি হাতুড়ি ও তোতার ব্যবহূত স্যান্ডেল উদ্ধার করে আলামত হিসেবে সংরক্ষণ করে। জামাল উদ্দীন হত্যা মামলার অগ্রগতির ব্যাপারে জানতে চাইলে শার্শা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সাতজন আসামির মধ্যে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে রাজু আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, সীমান্তে চোরাচালানি চক্রের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সাংবাদিক জামালকে হত্যা করা হয়েছে।
যুবদল নেতাকে পিটিয়ে হত্যা: গত ১৯ জুন রাতে বাড়ির টিনের চালে ঢিল ছুড়তে নিষেধ করায় যশোর জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুর রহমানের (৪৫) মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানায়, মামলার আসামিরা পলাতক থাকায় গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সুধীর রঞ্জন নাথ প্রথম আলোকে বলেন, ভঙ্গুর পরিবারের ছেলেরা অপরাধের সঙ্গে বেশি জড়িয়ে পড়ছে। সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ অনেক কমে গেছে। সার্বিকভাবে যার প্রভাব পড়ছে সমাজে।
পুলিশ সুপার কামরুল আহসান বলেন, সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টির জন্য স্কুল-কলেজে গিয়ে ছেলেমেয়েদের কাউন্সিলিং করার কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। মসজিদে বয়ানের সময় সচেতনতামূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ইমাম পরিষদকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যেসব কমিটি বা সংস্থা সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কাজ করে তাদের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.