কৃতদাস থেকে মানবাধিকার কর্মী by সিরাজুল ইসলাম

নেপালের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক ও শীর্ষ মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যে অন্যতম শান্তা চৌধুরী। তিনি ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট পার্টির নেতা ও সংসদ সদস্য। আলোর মশাল নিয়ে প্রতিনিয়ত ছুটে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। পাশে দাঁড়ান অসহায়দের। বাড়িয়ে দেন সহায়তার হাত।


অথচ তিনি সহ্য করেছেন অকথ্য দুঃখ-দুর্দশা আর নির্যাতন! দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে সমতল ভূমি তরাই অঞ্চলে থারু আদিবাসী পরিবারে তার জন্ম। অভাব-অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। অভাবের তাড়নায় এ আদিবাসীরা তাদের মেয়েদের ছয় বছর হলেই উচ্চবর্ণের জমিদার ও দালালদের কাছে বিক্রি করে দেন। এ থেকে রেহাই পাননি শান্তা চৌধুরীও। মাত্র ৮ বছর বয়সে ৭৫ মার্কিন ডলারের বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে দেন তার মা-বাবা। এ বয়সেই মনিবের ঘরদোর ঘষামাজা থেকে রান্নাবান্নার মতো সব কাজ সামলাতে হতো তাকে। ভোর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত ছোটাছুটি করতে হতো। সব কাজ শেষ করতে তার লাগত ১৯ ঘণ্টা! এভাবেই কেটে গেছে ১৮ বছর।
সেই শান্তা চৌধুরীই আজ প্রভাবশালী নারীদের একজন; কিন্তু ভুলতে পারেননি দাসত্ব জীবনের ভয়ানক সেই স্মৃতির কথা। সে কথা মনে পড়লে এখনও চোখের কোনায় পানি জমে। ভোর ৪টায় ঘুম থেকে জাগা, পান থেকে চুন খসলেই মনিবের পিটুনি ছিল তার নিয়তি। মনিব কর্তৃক অন্য নারী ধর্ষণ আর নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে থাকতে চান তিনি। শান্তার ভাষায়, নির্যাতনের কথা মনে পড়লে বুকটা ফেটে যায়। নিজের ওজনের চেয়েও ভারী জিনিস বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। অসুখ হলেও রক্ষা ছিল না তার। শান্তারা ৯ ভাই-বোন। ভূমিহীন মা-বাবার কাজেরও সুযোগ ছিল না। তাই বছরে মাত্র ছয় হাজার ৬০০ রুপি (৭৫ ডলার) চুক্তিতে তাকে এক জমিদারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২০০৬ সালে নেপালের সুপ্রিম কোর্টের এক আদেশবলে দাসত্বের কবল থেকে মুক্তি পান তিনি। একই সঙ্গে আদালত কামলারি প্রথাকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে রায় দেন। শান্তা এখন আদিবাসীদের ভূমি ফেরত চেয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। যোগ দিয়েছেন ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট পার্টিতে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে তাকে পার্লামেন্টে একটি আসন দেওয়া হয় (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার আওতায়)। শান্তা বলেন, সরকারি কর্মকর্তা, এমনকি মানবাধিকার কর্মীদের বাড়িতেও শিশু শ্রমিক রয়েছে। এসব বাড়িতে অভিযান চালাতে না পারলে সমস্যার সমাধান হবে না। তরাই অঞ্চলে সরকারিভাবে দাস প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে ৯০ বছর আগে; কিন্তু বিদ্যমান 'কামলারি' হচ্ছে দাস প্রথারই একটি রূপ। আর অভাবের তাড়নায় এ কাজটি করে থাকেন থারুরা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলে আসছে এ প্রথা। অথচ এক শতাব্দী আগেও থারুদের জমিজমা ছিল। সেখানে একটি সাধারণ রোগ ছিল ম্যালেরিয়া। প্রকৃতিগতভাবে এ রোগ তারা প্রতিরোধ করতে সক্ষম ছিল। ১৯৬০ সালে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটলে নিরক্ষর আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে উচ্চবর্ণের জমিদাররা। সে থেকেই নিজভূমে ক্রীতদাসে পরিণত হয় থারুরা। ঋণে জর্জরিত হয়ে বাধ্য হন মেয়ে বিক্রি করতে।
 

No comments

Powered by Blogger.