ক্যান্সার হাসপাতালের স্বপ্ন থেকে গেল অধরা by নওশাদ জামিল

নিউ ইয়র্কে চিকিৎসাধীন অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদ 'নো ফ্রি লাঞ্চ' শিরোনামে একটি মর্মস্পর্শী লেখা লেখেন। এতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন তাঁর এক স্বপ্নের কথা। বলেছিলেন, দেশ ও মানুষের জন্য ওই স্বপ্নপূরণের তিনি সব করবেন। লেখাটি প্রকাশিত হলে তাঁর ওই স্বপ্ন ছুঁয়ে গিয়েছিল সব মানুষের হৃদয়।


'নো ফ্রি লাঞ্চ' লেখাটির শেষ দিকে তিনি বাংলাদেশে একটি বিশ্বমানের ক্যান্সার হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্র স্থাপনের স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ চলে গেলেন, তাঁর সেই শেষ স্বপ্নও কি শেষ হয়ে যাবে? বাংলাদেশের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার্থে একটা হাসপাতাল করার সেই স্বপ্ন পূরণ করা অসম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন লেখকের বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজনরা। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা দরকার বলে তাঁরা মত দিয়েছেন।
লেখকের ছোট ভাই বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ও রম্য লেখক আহসান হাবীব বলেন, 'ভাইয়ার শেষ ইচ্ছার কথা, তাঁর স্বপ্নের কথা আমরা জানি। আমরাও চাই তাঁর নামে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল করতে। আমার বিশ্বাস, এটা সম্ভব। সবার সঙ্গে কথা বলেই এ বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।'
ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্যে 'নো ফ্রি লাঞ্চ' রচনায় হুমায়ূন লিখেছেন : 'সর্বাধুনিক, বিশ্বমানের একটি ক্যান্সার হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্র কি বাংলাদেশে হওয়া সম্ভব না? অতি বিত্তবান মানুষের অভাব তো বাংলাদেশে নেই। তাঁদের মধ্যে কেউ কেন স্লোয়ান বা কেটারিং হবেন না? বিত্তবানদের মনে রাখা উচিত, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যাংকে জমা রেখে তাঁদের একদিন শূন্য হাতেই চলে যেতে হবে। বাংলাদেশের কেউ তাঁদের নামও উচ্চারণ করবে না। অন্যদিকে আমেরিকার দুই ইঞ্জিনিয়ার স্লোয়ান ও কেটারিংয়ের নাম তাঁদের মৃত্যুর অনেক পরেও আদর-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে পৃথিবীতে স্মরণ করা হয়।'
'আমি কেন জানি আমেরিকায় আসার পর থেকেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি, হতদরিদ্র বাংলাদেশ হবে এশিয়ায় ক্যান্সার চিকিৎসার পীঠস্থান। যদি বেঁচে দেশে ফিরি, আমি এই চেষ্টা শুরু করব। আমি হাত পাতব সাধারণ মানুষের কাছে।'
ক্যান্সার চিকিৎসা যে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই চরম বাস্তবতাটি ওই লেখায় তুলে ধরতে গিয়েই তিনি বলেছিলেন তাঁর স্বপ্নের কথা। ক্যান্সারের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। দেশের অধিকাংশ মানুষের সামর্থ্য নেই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করার। কিন্তু প্রতিবছরই ক্যান্সার কেড়ে নেয় অনেক মানুষের জীবন। বিদেশে ক্যান্সার চিকিৎসা অত্যন্ত উন্নতমানের। কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। এ অবস্থা অনুধাবন করে তিনি দেশে বিশ্বমানের একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা পোষণ করেন। তাঁর এই মহতী ইচ্ছাকে তখন সাধুবাদ জানিয়েছেন তাঁর ভক্ত-অনুরাগী ও বিপুল পাঠকগোষ্ঠী।
লেখকের ঘনিষ্ঠজনরা জানান, হুমায়ূন আহমেদের নামে 'হুমায়ূন ক্যান্সার হাসপাতাল' করতে চাইলে দেশের সব মানুষই এগিয়ে আসবেন। তাঁরা বলেন, হুমায়ূন আহমেদের সেই শেষ ইচ্ছে পূরণের ভার পড়েছে তাঁর পরিবারের সদস্যসের ওপর। তাঁদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে লেখকের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও এ উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, "হুমায়ূন আমেরিকায় গিয়ে এই কালব্যাধির হিংস্রতা ও এর চিকিৎসার ব্যয়বহুলতা বিশেষভাবে টের পেয়েছিলেন। তাই এই বাংলাদেশেই সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ও অর্থায়নে এমন একটি সর্বাধুনিক ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে ধনী-গরিব সকলেই সমভাবে চিকিৎসা সুবিধা পাবে। কিন্তু জীবদ্দশায় তাঁর পক্ষে তা করা হয়ে উঠল না। তিরোধানের পর তাঁর অগণিত ভক্ত, অনুরাগী আর সরকারি-বেসরকারি তাবৎ উদ্যোগের সমন্বয়ে আমরা কি তাঁর স্মৃতিতে তাঁরই স্বপ্নাশ্রিত 'হুমায়ূন ক্যান্সার হাসপাতাল' বা তজ্জাতীয় একটি অনন্য আরোগ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে পারি না? আমার মতে, সেটিই হবে জাতীয় স্তরে তাঁর প্রতি আমাদের স্থায়ী শ্রদ্ধা। আসুন, আমরা তাঁর এই অসমাপ্ত স্বপ্নটি বাস্তবায়ন করি।"
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, 'সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দেশেই ক্যান্সার হাসপাতাল গড়া সম্ভব। আমাদের দেশে বিত্তবান মানুষের অভাব নেই। তাঁরাও এ বিষয়ে এগিয়ে এলে দেশেই হুমায়ূনের নামে ক্যান্সার গবেষণা ও হাসপাতাল হতে পারে। যাঁর যে অবস্থান আছে, সেখান থেকেই কাজের চিহ্ন রেখে যাওয়াই হলো মানুষ হিসেবে আমাদের বিধাতাপ্রদত্ত দায়িত্ব।'
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী নায়না তাবাচ্ছুম বলেন, স্যারকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য তাঁর এই শেষ ইচ্ছা পূরণ করা উচিত। এতে দেশ ও মানুষের অনেক কল্যাণ হবে। এটা হবে হুমায়ূন স্যারকে সম্মান দেখানোর জন্য সেরা কাজ। ক্যান্সার হাসপাতাল গড়ার কাজে দেশের সব মানুষ এগিয়ে আসবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, দলমত নির্বিশেষে হুমায়ূন আহমেদের গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা সর্বস্তরের মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত। মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল হৃদয়ের। হাসপাতাল গড়ার আহ্বানে কেউ সাড়া না দিয়ে থাকতে পারবে না।
ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সম্ভব কি না জানতে চাইলে হুমায়ূন আহমেদের অনুজ বন্ধু, স্থপতিবিদ ও লেখক শাকুর মজিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অবশ্যই সম্ভব। হুমায়ূন ভাইয়ের শেষ ইচ্ছাটি আমাদের সবার পূরণ করা উচিত। এর মধ্য দিয়ে দেশ ও জাতিরও উপকার হবে।'

No comments

Powered by Blogger.