ভিন্নমত-বিডিআরে বেসামরিক প্রশাসন by এ এম এম শওকত আলী

আইনি কাঠামোর আওতায় বিডিআরসহ যেকোনো সামরিক বাহিনীর বেসামরিক সরকারের আইনসিদ্ধ আদেশ-নির্দেশেই কাজ করার কথা। এসব বাহিনীর সরকারবহির্ভূত কোনো পৃথক অস্তিত্ব সংবিধানে বা প্রচলিত আইনে স্বীকৃত নয়। বেসামরিক সরকার প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বিডিআরের সদস্যদের ব্যবহার করে যাচ্ছে।


মূলত সামরিক সরকার শব্দটির ব্যবহার কাগজে-কলমে প্রচলিত থাকলেও ধারণাগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ভ্রান্ত। যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে সরকার হবে একটাই; তা হলো নির্বাচিত সরকার। এ সরকারকে খণ্ডিতরূপে দেখার প্রশ্নই ওঠে না। সামরিক সরকারের প্রশ্ন গণতান্ত্রিক ধারণার পরিপন্থী। এই শব্দ দুটি তখনই ব্যবহূত হয়, যখন দেশে নির্বাচিত সরকারকে অপসারণ করে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়। এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় সামরিক অভ্যুত্থান। দক্ষিণ এশিয়াসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতায় যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত তা হলো, সংবিধান ও আইনবহির্ভূতভাবে এ ধরনের সামরিক সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ প্রধানত দুটি। এক. দেশের অভ্যন্তরে এ ধরনের সরকারের বিরুদ্ধে জনমত। দুই. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ক্রমবর্ধমান চাপ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আদর্শিকভাবে এ ধরনের সরকার সমর্থন করে না।
সামরিক প্রশাসন ও বেসামরিক প্রশাসন—শব্দ দুটি ব্যবহারের উৎস ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলের শাসনব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার আওতায় তৎকালীন অখণ্ড ভারতে ঔপনিবেশিক প্রশাসনকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হতো—সিভিল ও মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট। এটা করা হতো বাজেট প্রণয়নের জন্য। বাজেট যদিও একটি বাজেটই হতো, তা সত্ত্বেও হিসাব নিরীক্ষার সুবিধার্থে এর প্রয়োজন অনুভূত হয়। এ ধারা এখনো অনুসৃত হয়। সামরিক বাহিনী প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় সব দেশেই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। বাংলাদেশেও এটি প্রচলিত রয়েছে। তবে দুই দফার সামরিক শাসনের দ্বিতীয় দফায় সামরিক বাহিনীর জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়বহির্ভূত একটি নতুন বিভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভাগটি সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ হিসেবে অভিহিত। বিভাগটি ১৯৯১ সাল-পরবর্তী পর্যায় থেকেই সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অংশবিশেষ। কোনো গণতান্ত্রিক সরকার সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত এ বিভাগকে অবলুপ্ত করার প্রয়োজন বোধ করেনি। এর কারণ গবেষণার দাবি রাখে।
বিডিআর অথবা যে নামেই এ সংস্থাকে অভিহিত করা হোক না কেন, সামরিক বাহিনীর অংশ নয়। এ সংস্থাটি আইন দ্বারা স্বীকৃত এবং ঐতিহ্যগতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতাভুক্ত। সাধারণভাবে একে আধাসামরিক বাহিনী হিসেবে অভিহিত করা হয়। এর পূর্ব-ইতিহাস ব্রিটিশ আমলের ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলসের সঙ্গে যুক্ত। পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। এর মূল কর্মকাণ্ড সীমান্ত এলাকায়। বিডিআরের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। তবে সীমান্তবর্তী এলাকায় বিডিআরের দায়িত্ব প্রধানত দুটি। এক. সীমান্তে চোরাচালান দমন, দুই. সীমান্তবর্তী এলাকায় বেসামরিক বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা বিধান; যাতে করে সীমান্তবহির্ভূত এলাকার কোনো দেশের বাহিনী এ নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করতে পারে। বিডিআরের তৃতীয় দায়িত্বটি সাময়িক। সরকার প্রয়োজনবোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিডিআরকে ব্যবহার করে, যা এর আগে উল্লেখ করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকার জননিরাপত্তা ও অনুপ্রবেশ বন্ধ করার যে দায়িত্ব বিডিআর পালন করে থাকে, সে দায়িত্বকে এক কথায় বলা যায় প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত প্রাথমিক দায়িত্ব বা ফার্স্ট লাইন অব ডিফেন্স।
বর্তমানে বিডিআর আইনে কিছু সংশোধনীর প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় পত্রিকান্তরে দেখা যায় যে বিডিআরে বেসামরিক ও আইনবিষয়ক কর্মকর্তা নিয়োগ করার চিন্তাভাবনা সরকারি নীতিনির্ধারকেরা করছেন। বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে এ ধরনের কোনো চিন্তা কোনো নির্বাচিত অথবা সামরিক সরকার করেনি। এখন এ চিন্তা কেন করা হচ্ছে, এর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রকাশিত সংবাদে পাওয়া যায়নি।
যে বিষয়টি চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো, সিভিল এবং লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স নামে প্রস্তাবিত নব্যসৃষ্ট শাখার কর্মকর্তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরা সেক্টর সদর দপ্তরে বেসামরিক প্রশাসন অর্থাৎ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করবেন। বেসামরিক অভাব-অভিযোগের বিষয়েও তাঁরা ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া ভূমিসংক্রান্ত সব ধরনের জটিলতা নিরসন, বিডিআরের মামলা পরিচালনাসহ জেলা পর্যায়ে, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিশ্চয়তা বিধানও হবে এ শাখার দায়িত্ব। এ ধরনের নতুন প্রস্তাবের পক্ষে এ যুক্তিও প্রদর্শন করা হয়েছে যে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতির অভাবে বিডিআরের সদস্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
বিডিআরের একজন সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক এ বিষয়ে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। সাবেক মহাপরিচালক বলেছেন, এতে বিডিআরের কাজের সুবিধা হবে। এর নজির অনেক বাহিনীতে রয়েছে। কিন্তু কোন বাহিনীতে রয়েছে তা বলা হয়নি। বর্তমান মহাপরিচালকের প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। তাঁর ভাষায়, ‘এ বাহিনীকে তার মতো করেই চলতে দিতে হবে। এমন কোনো কিছু করা ঠিক হবে না, যাতে বাহিনীর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়।’
সার্বিক বিচারে প্রতীয়মান হয় যে এ ধরনের প্রস্তাব অপরিপক্ব মস্তিষ্কপ্রসূত। যেসব যুক্তি প্রস্তাবের পক্ষে দেওয়া হয়েছে তা বহুবিধ কারণে নিতান্তই অসার। এক. সীমান্তে ভূমিসংক্রান্ত বিরোধ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর আন্তর্জাতিক সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের ভূমি দখলের চেষ্টা করলে তা অবশ্যই বিডিআর প্রতিরোধ করবে এবং সফলতার সঙ্গে এ কাজটি বিডিআর বরাবরই করে আসছে। এ প্রক্রিয়ায় বিডিআর এবং অন্য দেশের সংশ্লিষ্ট সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে ফ্ল্যাগ মিটিংয়ের মাধ্যমে পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানে লিপ্ত হয়। এ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য সমাধানের চেষ্টা ব্যর্থ হলে দুই দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে বিরোধের বিষয়ে সীমান্তরেখার জটিলতার বিষয়ে বাংলাদেশের ভূমি জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অন্য দেশের একই অধিদপ্তরের প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করে নিষ্পত্তি করে থাকেন। ১৯৪৭ সাল থেকেই এ পদ্ধতি অনুসরণীয় ছিল। এখনো তা বিদ্যমান। এখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন কেন?
চোরাচালানসহ সীমান্তে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের যে প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে, সে বিষয়টিও বোধগম্য নয়। সাধারণ অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতি জেলায় থানা রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় প্রতি জেলায় রয়েছে র‌্যাব। এসব অপরাধ দমনের দায়িত্ব কখনো বিডিআরের ছিল না, এখনো নেই। চোরাচালান দমনসংক্রান্ত বিষয়েই বিডিআরের দায়িত্ব সীমিত। এর জন্য প্রতি জেলায় সমন্বয় ও পরিবীক্ষণের দায়িত্ব জেলা চোরাচালান দমনসংক্রান্ত কমিটির, যেখানে বিডিআরের প্রতিনিধিও একজন সদস্য। প্রতি জেলায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বিদ্যমান। এ সত্ত্বেও কেন সেক্টর সদর দপ্তরে এক বা একাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের প্রয়োজন। সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিশ্চয়তা বিধান আইনি দৃষ্টিকোণে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারের, বিডিআরের নয়। এ জন্য প্রতি জেলায় ও উপজেলায় আইনশৃঙ্খলা কমিটি বহু বছর ধরে সক্রিয়; যদিও এর সুফল জনগণ পাচ্ছে কি না, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। অনেকের মতে, সুফল অর্জনে ব্যর্থতার জন্য একটি বিষয় দায়ী: কার্যকর সমন্বয়ের অভাব।
আইনবিষয়ক কর্মকর্তা বিডিআরের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে। বিডিআরের মামলা পরিচালনার বিষয়টি পৃথকভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র এই বাহিনীর শৃঙ্খলা ভঙ্গের মামলাই বিডিআর নতুন আইন অনুযায়ী করবে। এ বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। অন্যান্য মামলা আইন অনুযায়ী পাবলিক প্রসিকিউটর এখনো পরিচালনা করছেন। এ প্রথার ব্যত্যয় হবে কেন। অন্যদিকে আইনি পরামর্শের জন্য জেলা থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
প্রস্তাবের পক্ষে অন্য একটি যুক্তি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দাবি করা হয়েছে যে দুর্যোগের সময় বিডিআরের সদস্যরা যে দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তা বেসামরিক ধরনের। এ ক্ষেত্রে বেসামরিক কর্মকর্তারা অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারেন। এ ধরনের যুক্তি যিনি বা যাঁরাই উত্থাপন করেছেন, তাঁরা যে বিদ্যমান এ-সংক্রান্ত সরকারি ব্যবস্থাপনা-কাঠামো সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জেলা পর্যায়ে এ দায়িত্ব ১৭৮৯ সাল থেকেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা ডেপুটি কমিশনার পালন করছেন। এ বিষয়টি ১৯২১ সালে প্রণীত বেঙ্গল ফ্যামিন ম্যানুয়ালে স্বীকৃত। ১৯৬১ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বিস্তারিত দায়িত্ব প্রত্যেক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকেই দেওয়া হয়। এর আনুষ্ঠানিক নাম ইমার্জেন্সি স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অ্যান্ড ইনস্ট্রাকশনস। এর জন্য পৃথকভাবে কোনো বেসামরিক কর্মকর্তার প্রয়োজন নেই। তবে প্রয়োজনবোধে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাঠপর্যায়ে জনবল বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপ্রসূত এ ধরনের প্রস্তাবিত পদক্ষেপ প্রতিষ্ঠিত দুর্বল কাঠামোকে দুর্বলতর এমনকি অকার্যকর করবে। প্রতিষ্ঠিত কাঠামোকে অধিকতর শক্তিশালী করা প্রয়োজন। প্রস্তাবিত আইনের আগে যে খসড়া আইন বিডিআর সরকারের কাছে পেশ করে, সে খসড়ায় বিডিআরের সদস্যদের ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়ার বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল মর্মে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়। এ প্রস্তাব সরকার সংগত কারণেই গ্রহণ করেনি। মোগল আমল থেকেই প্রচলিত শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয়ভাবে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের ক্ষমতার পরিধি পৃথকভাবে নির্ধারিত ছিল। কোতোয়াল বা ফৌজদার কখনো বিচারিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল না। ব্রিটিশ আমলেও আইনের শাসনের স্বার্থে যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল, তার সোজা অর্থ ছিল, যার হাতে বন্দুক তাকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। সরকারও এ নীতির ব্যত্যয় করেনি। বিডিআরের মহাপরিচালকের অধীন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা আইন কর্মকর্তার কোনো প্রয়োজন নেই।
এ এম এম শওকত আলী: সাবেক সচিব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

No comments

Powered by Blogger.