সফট টার্গেট by সুভাষ সাহা

স্টার জলসার ডিটেকটিভ সিরিয়াল 'চেকমেট'-এর এক ইপিসোডে প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিস মৃণালিনী দস্তিদার শেষ পর্যন্ত এক প্রাণোচ্ছল নবীন টিভি সাংবাদিক হত্যার কিনারা করে উঠতে পেরেছিলেন। দেখা গেল, যিনি একটি টিভি চ্যানেল দিয়ে বসেছেন, তিনিই আবার আঁধারের ভয়ঙ্কর জীব।


ওই তরুণী সাংবাদিকটি মাদকের বিরুদ্ধে একটি সেনসেশনাল রিপোর্ট করবেন বলে ওই মালিক পরিচালকের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। ভদ্রলোকের মুুখোশ পরা মালিক ভাবলেন, নবীন সাংবাদিক আর কতদূর যেতে পারবেন! কিন্তু দেখা গেল, নির্দিষ্ট অঞ্চলের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারীর হদিস করতে গিয়ে তার নিজেরই ডেরায় পেঁৗছে গেছেন ওই সাংবাদিক। আর তখনই দু'চোখে স্বপ্ন নিয়ে আসা নবীন সাংবাদিকের ভাগ্য লেখা হয়ে গিয়েছিল। ওই সাংবাদিকের দেহ টিভি মালিকরূপী মাদক ব্যবসায়ীর গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিথর হয়ে গিয়েছিল।
টিভি সিরিয়ালের চেয়েও বাস্তব কখনও কখনও আরও নির্মমতা নিয়ে হাজির হয়।আমাদের এখানে ১৯৯২ সাল থেকে অন্তত ১২ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তার ক'টির বিচার শেষ হয়েছে? সর্বশেষ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কথাই ধরা যাক। প্রথম দু'তিনদিন এই নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কয়েকটি পত্রিকা ও টিভিতে মুখরোচক সংবাদ প্রকাশিত হলো। তখনই বোঝা গিয়েছিল, এসব গল্প ফাঁদা হচ্ছে জোড়া খুনের মোটিভ আড়াল করার উদ্দেশ্যে। কী আশ্চর্য, এত বড় একটা সেনসেশনাল মার্ডারের ক্রাইম দৃশ্য পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সংরক্ষণ করতে বেমালুম ভুলে গেল!
আসলে সাংবাদিকরা হত্যা-গুম ও নির্যাতনের সফট টার্গেট কি-না! সাংবাদিকরা ক্রাইম থেকে শুরু করে রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, পরিবেশ পর্যন্ত সব ধরনের ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। এগুলোর মধ্য থেকে নির্দিষ্ট মিডিয়ার পলিসি অনুযায়ী প্রকাশ পায়। যারা দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, অবৈধ ব্যবসা করে, মাদক ব্যবসায়ী, কালো টাকার পাহাড় গড়ে, সেই সাম্রাজ্যের কেউ কেউ নির্দিষ্ট সাংবাদিকের লেখায় বা প্রতিবেদনে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওই সাংবাদিককে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতে পারে। কারণ তারা ভালো করেই জানে, সাংবাদিকের সাহস, মেধা, জনস্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা ছাড়া নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেই।
পাকিস্তানের সাংবাদিক শাহজাদকে আল কায়দা ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর মধ্যে সংযোগ আবিষ্কার করে লেখা প্রকাশের পর ২০১১ সালের মে মাসে হত্যা করা হয়। মৃত্যুর আগে তিনি তার সহকর্মীদের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে কয়েক মাস ধরে হুমকি পাওয়ার কথা বলেছিলেন। ভারতের সাংবাদিক চন্দ্রিকা রাই, তার স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তানকে একসঙ্গে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ধারণা করা হয়, খুনি-মাফিয়ারা তাকে তার এ সম্পর্কিত ধারাবাহিক রিপোর্ট প্রকাশের জন্য হত্যা করে থাকতে পারে। ভারতেরই আরেক সাংবাদিক জ্যোতির্ময় দে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। তাকে মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন ছোটা রাজনের নির্দেশে হত্যা করা হয়। তার অপরাধ, তিনি ধারাবাহিকভাবেই মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের নানা অপকমের্র বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ করতেন। এভাবে অনেক সাংবাদিক হত্যার সঙ্গে উচ্চপদস্থ আমলা, ব্যবসায়ী থেকে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও জড়িত থাকতে দেখা গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিশেষত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ হতে চায় না। এই দেখুন না! সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ক্লু পর্যন্ত এখনও নাকি পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এ জন্য মারহাবা দিতে হয়!
স্টার জলসার চেকমেটের মিস দস্তিদারের মতো কেউ সাগর-রুনি হত্যার কিনারা করতে কি যাবেন এ দেশে? হত্যার পরিকল্পনাকারীরা কি এতই শক্তিশালী যে, তাদের টিকিটিও প্রশাসন স্পর্শ করতে পারবে না? আসলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা হলো জনগণের সচেতনতা ও সামাজিক আন্দোলনের তোড়। এই দুটির বড্ড অভাব এ দেশে। যেটুকু আছে তাও মতলববাজির ফেরে আটকা। দেখা যাক, সাংবাদিকদের চলমান আন্দোলন কতটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

No comments

Powered by Blogger.