চরাচর-ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতা by হাকিম বাবুল

'কাগজের ঘুড্ডি পবনে উড়াইলি গো সই...' রোমান্টিক বাংলা গানের কলি এটি। লাল, নীল, সাদা, কালো, হলুদ, সবুজ- একরঙা, বহুরঙা ঘুড়ি যখন আকাশে উড়তে থাকে, তখন এক মধুর আনন্দানুভুতি হৃদয়তন্ত্রীতে দোলা দিয়ে যায়। আর ঘুড়ির সুতায় টান, চক্কর খাওয়া কিংবা গোত্তা খাওয়া দেখতে কিংবা খেলতে কার না ভালো লাগে।


আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যের নানা লোকজ খেলার মধ্যে অন্যতম এই ঘুড়ি খেলা। শহুরে নাগরিক জীবনেই হোক আর গ্রামীণ পরিবেশেই হোক, ঘুড়ি ওড়ানোর শখ এখনো অনেককে টানে। খোদ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় ঘুড়ি উৎসব।
ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য বাতাসের বেগ প্রয়োজন। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাস ঘুড়ি ওড়ানোর আদর্শ সময়। এ সময় গ্রামগঞ্জে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়ে যায়। গ্রামের খোলা মাঠে, শহরের বাসাবাড়ির ছাদে কিংবা উন্মুক্ত পার্ক-মাঠে ঘুড়ি নিয়ে মেতে ওঠে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-বৃদ্ধ ঘুড়িয়ালরাও। শহুরে নাগরিক জীবনে ঘুড়ি উৎসবে শখ করে শিশুদের নিয়ে নারীদেরও ঘুড়ি ওড়াতে দেখা যায়। ঘুড়ির মধ্যেও প্রকারভেদ রয়েছে। রয়েছে তৈরির কৌশল। এমনিতে সচরাচর চারকোনা ঘুড়ি দেখা যায়। ওড়ানোর জন্য এই ঘুড়িই আদর্শ। তা ছাড়া বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর মুখাকৃতির ঘুড়িও দেখা যায়। যেমন- সাপঘুড়ি (চারকোনা কিংবা সাপের ফণার মুখোশ বানিয়ে নিচে লেজ জুড়ে দেওয়া হয়), চিলঘুড়ি, ঢাকঢোল ঘুড়ি, টিন (চৌকোনা টিন আকৃতির ঘুড়ি), চঙ্গপাইট ঘুড়ি। চঙ্গপাইট ঘুড়ির ওপরের দিকের দুই পাশে ছোট ছোট দুটি ও নিচে বড় আকৃতির একটি ত্রিকোণ পতাকা লাগিয়ে সঙ্গে হারিকেন ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, যাতে রাতের আকাশেও সেই ঘুড়ি দেখতে পাওয়া যায়। এসব ঘুড়ি ওড়ানো হয় নির্মল আনন্দের জন্য। আর বৈশাখী মেলা শেষে শুরু হয় ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতা (স্থানীয়ভাবে যা 'ঘুড্ডির প্যাঁচ খেলা' বলেই সমধিক পরিচিত)। স্থানীয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় এ প্রতিযোগিতা। বৈশাখী ঘুড়ি উৎসব উদ্যাপন কমিটি নামে একটি কমিটি এ ঘুড়ি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। এবার নিয়ে তিন বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। গত ৮ মে সপ্তাহব্যাপী এ ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকীর হোসেন। শত শত লোক এই ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতা উপভোগ করে। 'লাইগা গেছে প্যাঁচ, প্যাঁচের মধ্যে প্যাঁচ', 'দে ঢোলের বাড়ি', 'শনঅ দে', 'দে গুঁতা'- এমন শব্দে দর্শক-সমর্থকরা ঘুড়িয়ালদের উৎসাহিত করে থাকেন। এবারের ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতায় জেলার ২৭ জন লাটাইধারী ঘুড়িয়াল গিয়েছিলেন। সাতটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এসব প্রতিযোগী রাউন্ড রবিন লীগ ভিত্তিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এটি এখন শেরপুরে সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই ঘুড়ি কাটাকাটি প্রতিযোগিতার জন্য লাটাইধারী ঘুড়িয়ালরা বছর ধরেই প্রস্তুত হতে থাকেন। এ জন্য তাঁরা ভারত ও পাকিস্তান থেকেও প্যাঁচ খেলানোর জন্য অর্ডার দিয়ে সুতা আনেন। সেই সুতা আবার বিশেষ কায়দায় ধারালো করেন, যাকে বলা হয় 'মাঞ্জা'। সুতারও রয়েছে বাহারি নাম- 'বর্তমান', 'জানবাজ', গোপন', 'জলপরী', 'কালাজান', পেণ্ডুলা' ইত্যাকার নামের সুতা। 'বর্তমান' আসে ভারত থেকে আর 'পেণ্ডুলা' পাকিস্তানি। ঢাকার চকবাজার ও সদরঘাট থেকে প্রতি রিল ১০০ থেকে ৩০০ টাকা দরে কিনে আনা হয়। তারপর সুতা মাঞ্জা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় কাচের গুঁড়া, তোকমা, জিগার আঠা, ইছবগুলের ভুসি, গদের আঠা, কাঠের গুঁড়া, খারাজুড়া গাছের ছাল, শিরীষ প্রভৃতি। কড়া রোদে সুতা মাঞ্জা দিয়ে শুকানো হয়। ঘুড়ি কাটাকাটির মতো গ্রামীণ লোকজ খেলাগুলো সাধারণ মানুষের আনন্দ-বিনোদন ও ঐতিহ্যের স্বার্থেই আমাদের টিকিয়ে রাখতে হবে।
হাকিম বাবুল

No comments

Powered by Blogger.