মানুষ কী চায়-ভেবে দেখার সময় এখনই

রাজনৈতিক নেতাদের কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ তাঁদের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে চায়। পাঁচ বছর পর পর দেশের মানুষ উৎসবের আমেজ নিয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শুধু যে নিজেদের অধিকার প্রয়োগ করে আসে, তা নয়- ব্যালট নামের এক টুকরো কাগজের ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষ নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটাও মিলিয়ে নিতে


চায়। দেশের মানুষের চাওয়া খুব সামান্য। সেই সামান্য চাওয়া নিশ্চিত করতেই ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাওয়া। মানুষের এই চাওয়া কতটুকু পূরণ হয়েছে? স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে এসে এখন হিসাব মিলিয়ে দেখতে গেলে একটু হতাশই হতে হবে। এখন পর্যন্ত কাটল না রাজনৈতিক অস্থিরতা। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে নতুন করে আবার রাজনৈতিক অঙ্গন অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। এমন একটি সময়ে প্রধানমন্ত্রী এক সংবর্ধনা সভায় দেশের মানুষের চাওয়া নিয়ে কিছু কথা বলেছেন।
হোক তা তত্ত্বাবধায়ক প্রসঙ্গে, তার পরও একটি বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দেশের মানুষের চাওয়া যখন উপলব্ধি করতে পেরেছেন, তখন অন্য সব বিষয়েও যে তিনি ওয়াকিবহাল, এটা আশা করতে বাধা কোথায়? দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে তো এমন উচ্চারণই আশা করে দেশের মানুষ। তিনি নিশ্চয়ই মানুষের সে চাওয়ার মূল্য দিতেও জানেন। মানুষের মনের কথা পড়তে পারা এক কঠিন কাজ। সবার দ্বারা এটা সম্ভব হয় নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এটা দেশের মানুষ চায় না। তিনি এ ব্যবস্থাকে দানব হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতায় এমন কথা যেকোনো রাজনৈতিক নেতাই উচ্চারণ করতে পারেন। এটাই স্বাভাবিক। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের অজুহাতে নতুন যে সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, সেটা সফল হয়নি। এর পাশাপাশি এটাও মানতে হবে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের প্রয়োজন দেশের রাজনৈতিক দলগুলো অনুধাবন করতে পেরেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হলে দেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। গত বৃহস্পতিবারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী উন্নত বিশ্বের উদাহরণ তুলে ধরে বলেছেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেভাবে গণতন্ত্র চলছে, আমাদের দেশেও সেভাবে চলবে। প্রধানমন্ত্রীর এই কথা আমাদের আশাবাদী করে। দেশের মানুষ তাঁর এই দৃঢ় উচ্চারণের ভেতর দিয়ে কয়েকটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়।
বাংলাদেশে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল, তখনকার প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবতে হবে। দেশে যখন প্রধানমন্ত্রী কথিত দানবরূপী তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছিল, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট ছিল। সেই সংকট কি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে? গত ১৬ বছরে রাজনৈতিক দলগুলো দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে কি একটি ঐকমত্যে পেঁৗছাতে পেরেছে? পৃথিবীর আর দশটা গণতান্ত্রিক দেশে বাংলাদেশের মতো রাজনৈতিক হানাহানি হয় না। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নয়, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে। যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, বিরোধী দল সরকারের সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। দেশের কল্যাণে সরকার ডাকলে বিরোধী দলকে জনকল্যাণে পাশে পায়। বিরোধী দল সরকারের সমালোচনা করতেও ছাড়ে না। সরকারের সামান্য বিচ্যুতিতে বিরোধী দল সমালোচনায় মুখর হয়। সরকারও নিজেদের ত্রুটি সংশোধনে সচেষ্ট হয়। পৃথিবীর আর দশটা দেশের মতো আচরণ আমাদের দেশে কি আশা করা যায়? এখানে বিরোধী দলের প্রধান কাজ নিছক বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা করা। সরকারের কোনো উন্নয়নকাজই বিরোধী দলের চোখে পড়ে না। অন্যদিকে সরকার বিরোধী দলের সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতে পারে না। যেখানে গণতন্ত্রে সংসদই হচ্ছে মূলকেন্দ্র, সেখানে বিরোধী দল দিনের পর দিন সংসদ অধিবেশন বয়কট করে। আর রাজপথের সহিংসতা যখন আছে, তখন নৈরাজ্য তো সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে 'সঠিক পথে' আনার ধমকও আছে। তার পরও আশাবাদী হতে হয় প্রধানমন্ত্রীর উচ্চারণে। আমাদের রাজনীতির জন্য এটা অত্যন্ত ইতিবাচক একটি ব্যাপার।
সাধারণ মানুষের মনের কথা বুঝতে পারলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনিতেই পাল্টে যাবে। আমাদের নেতাদের এখনই ভাবতে হবে মানুষ কী চায়। মানুষের চাওয়ার মূল্য দিতে শিখতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.