শিক্ষা-সম্মান কোর্স চালুর আড়ালে অসম্মানের চিত্র by তুহিন ওয়াদুদ

দেশের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী সম্মান কোর্সে পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অথচ সরকারের সবচেয়ে বেশি বিমাতাসুলভ আচরণ তার প্রতি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজগুলোতে সম্মান কোর্স চালু করার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান কোর্সের শিক্ষার মান সমুন্নত করা প্রয়োজন এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে


সম্মান কোর্সের প্রচলন কতখানি যৌক্তিক তা ভেবে দেখা প্রয়োজন

হাসান আজিজুল হকের অনেক দিন আগে শোনা বক্তব্য থেকে একটি কথা বাণীরূপ সত্যি মনে হচ্ছে। হাসান স্যার বলেছিলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর কলেজে ডিগ্রি খুলছে। সরকার শিক্ষার সম্প্রসারণ করছে। সেই সম্প্রসারিত রূপটি এতটাই ব্যাপক এবং সেখানকার প্রধান ফটকটি এত বড় যে, সেই ফটক দিয়ে শিক্ষার্থীরা আসা-যাওয়া করে; কিন্তু শিক্ষার ছোঁয়া তাদের চেতনায় লাগে না। বর্তমানে অবস্থাটা আক্ষরিক অর্থে সত্যি বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। হাসান স্যার প্রায় এক যুগ আগে কলেজগুলোর ডিগ্রি পর্যায় সম্পর্কে কথাগুলো বলেছিলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ডিগ্রি পর্যায় খোলা প্রায় শেষ হয়েছে। এখন তাই চলছে সম্মান কোর্স খোলার প্রতিযোগিতা। উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে একজন এমপি কিংবা উপজেলা চেয়ারম্যান সাধারণত কলেজের সভাপতি থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা তাদের আগামী ভোটপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজে সম্মান কোর্স চালু করছেন। স্থানীয়ভাবেও মনে করা হচ্ছে, এলাকায় সম্মান শ্রেণীতে পাঠদান হয় এরূপ কলেজ এলাকাবাসীকে উচ্চশিক্ষিত করে তুলবে। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের জন্য বর্তমানে যেমন অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হওয়া বাধ্যতামূলক, একদিন হয়তো সবার জন্য উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণী পাস করা বাধ্যতামূলক হবে। দেশের সব নাগরিককে উচ্চমাধ্যমিক পাস করানো খুব কঠিন কাজ হবে না। দেশে উচ্চশিক্ষা যেমন বেসরকারিকরণ করার মাধ্যম সার্টিফিকেট পাওয়াকে সহজলভ্য করে তুলেছে, একদিন বেসরকারি শিক্ষা বোর্ড প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এসএসসি এবং এইচএসসি পাসের সনদকে সহজলভ্য করে সরকার দেশের নাগরিকদের শতভাগ উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণী পাস করানোর কৃতিত্ব অর্জন করার চেষ্টা করবে। এর পরবর্তী পর্যায়ে দেশের সব নাগরিককে স্নাতক সম্মান এবং স্নাতকোত্তর শ্রেণী পাস করানো হবে। এরপর দেশের সব নাগরিককে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করার ব্যবস্থা হবে। সে চেষ্টা যাতে অসম্ভব হয়ে না পড়ে তার জন্য প্রস্তুতি চলছে এখন থেকে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে সম্মান কোর্স চালু করার সরকারি যে উদ্যোগ তা কতখানি সম্ভব সে কথা কি সরকার ভেবেছে? এই প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। কারমাইকেল কলেজ কিংবা বরিশাল বিএম কলেজের জন্য যে সিলেবাস গ্রামের কলেজগুলোর জন্যও একই সিলেবাস। এই সিলেবাসের ভার বহন করা কারমাইকেল কলেজের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পক্ষে বহন করা কঠিন। সেখানে গ্রামের কলেজগুলোর পক্ষে তা আরও কঠিন। শিক্ষার্থীদের দুর্বলতার কথাতেই শেষ নয়। কলেজগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বইয়ের সুবিধাও নেই। সম্মান এবং স্নাতক শ্রেণী পাঠ শেষ হবে তবুও হয়তো একটি সেমিনারও অনুষ্ঠিত হবে না। এই কলেজগুলোতে যারা পড়াবেন তারা কতখানি যোগ্য সে কথাও ভাবা প্রয়োজন। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত কলেজের উচ্চমাধ্যমিক কিংবা ডিগ্রি পর্যায়ে যেখানে ভালো শিক্ষক পাওয়া যায় না, সেখানে সম্মান শ্রেণীর কোর্সের জন্য নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের পদের অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত না থাকা পদে শিক্ষকরা কেন পড়াতে আসবেন। ফলে যাদের চাকরি কোথাও হচ্ছে না, তারা তাদের বেকারত্ব নামক অপমানজনক শব্দ থেকে নিস্তার পাওয়ার লক্ষ্যে এসব পদে চাকরি করতে আসছেন এবং আসবেন। তাহলে বাস্তবতা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা কোথাও ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। তারা এসব কলেজে সম্মান কোর্সে ভর্তি হচ্ছে এবং হবে। আর যে বেকাররা কোথাও চাকরি পায় না তারা হাজারো অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও এসব শিক্ষার্থীকে পড়াতে আসছেন। দুর্বল শিক্ষার্থী, দুর্বল শিক্ষক, শক্ত সিলেবাস_ এই তিনের রসায়ন কীরূপ হতে পারে সরকার কি তা ভেবে দেখেছে? সরকার শিক্ষার সম্প্রসারণের চেষ্টা থেকে যদি এসব কলেজে সম্মান কোর্স চালু করতে চায় তাহলে তা পরিকল্পিত হওয়া প্রয়োজন। সম্মান কোর্স চালু করার জন্য আবেদন করতে হলে কলেজে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষকের বাইরে তিনজন করে শিক্ষক থাকতে হয়। এই তিনজন শিক্ষকের বেতন হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথামতো শিক্ষক নিয়োগ হয় কিন্তু বেতনের জন্য নির্ভর করতে হয় মন্ত্রণালয়ের ওপর। মন্ত্রণালয় সম্মান কোর্সের জন্য নিয়োগ করা শিক্ষকদের জন্য বেতনের অনুমোদন এখন পর্যন্ত দেয়নি। এদিকে প্রতিদিন বাড়ছে সম্মান কোর্সের জন্য নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকের সংখ্যা। এরা যখন সংখ্যায় অনেক হবে তখন তারা সরকারকে জিম্মি করে পড়ানোর বদলে রাজপথে নামবে। তখন হয়তো বিরোধী দল এসে অনশনরত শিক্ষকদের আশ্বস্ত করবে তারা ক্ষমতায় গেলে বেতন হবে। তার চেয়ে ভালো হতো যদি সরকার সম্মান কোর্স বেসরকারি কলেজে ব্যাপকভাবে চালু করার সঙ্গে সঙ্গে সেসব কলেজের প্রয়োজনীয় শিক্ষকদের জন্য বেতনের নিশ্চয়তা প্রদান করত। তাহলে হয়তো তুলনামূলক ভালো প্রার্থীরা আবেদন করতেন। আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত সরকার বৃহৎসংখ্যক বেতনবঞ্চিত শিক্ষককে বেতন প্রদান করবে। কিন্তু শুরুতে বেতন না দেওয়ার কারণে তুলনামূলক কম যোগ্যতাসম্পন্নদের চাকরির ব্যবস্থা করার পর তাদের আর্থিক সুবিধা দেওয়ার চেয়ে শুরুতে তাদের বেতনের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ছিল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুমতিসাপেক্ষে ডিগ্রি কলেজগুলোতে থার্ড পোস্ট হিসেবে যে পদগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষকের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে সেসব পদের বেতন না হওয়ার কারণে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। সেই মানবেতর জীবনের দিকে নতুন নতুন শিক্ষকদের আবার ঠেলে দেওয়ার একটা চেষ্টা চলছে। এ পর্যন্ত যে কলেজগুলোতে সম্মান কোর্স চালু করা হয়েছে তার চেয়ে অধিক কোনো কলেজে যেন সম্মান কোর্স চালু করা না হয়। শিক্ষাকে যদি উৎপাদিত পণ্যও মনে করি, তা হলেও অর্থনীতির ভাষায় বলতে হয় পণ্যের যদি সরবরাহ বেশি হয় এবং মান খারাপ হয় তাহলে তা কেউ ক্রয় করে না। আমাদের দেশে তথাকথিত শিক্ষিতের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু মান বাড়েনি বলে তার বাজারমূল্য খুব কম। দেশের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী সম্মান কোর্সে পড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অথচ সরকারের সবচেয়ে বেশি বিমাতাসুলভ আচরণ তার প্রতি। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজগুলোতে সম্মান কোর্স চালু করার আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান কোর্সের শিক্ষার মান সমুন্নত করা প্রয়োজন এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সম্মান কোর্সের প্রচলন কতখানি যৌক্তিক তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।

ড. তুহিন ওয়াদুদ : শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া
বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.