পর্যটন-এই শিল্পকে হরতালের আওতামুক্ত রাখুন by তৌফিক রহমান

দেশে এখন সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গত কয়েক দিনের বিরাজমান পরিস্থিতি এবং বিরোধী দলের ডাকা হরতালে দেশের অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যের মতো পর্যটনশিল্পেরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এমনিতেই ঝড়-ঝঞ্ঝা, খরা-বন্যা আর নেতিবাচক ভাবমূর্তির দেশ হিসেবে বিশ্বে আমাদের পরিচিতি রয়েছে।
ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আর রপ্তানি বাণিজ্যে গুটিকয়েক পণ্য ছাড়া আমাদের ঈপ্সিত তেমন সাফল্যও নজরে পড়েনি।
যে শিল্প এককভাবে বিশ্ব জিডিপিতে প্রায় ১০ শতাংশ কন্ট্রিবিউট করছে, সে শিল্প পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান শিল্প কিংবা যে শিল্পে ১০০ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়—সে পর্যটনশিল্প আমাদের দেশে বরাবরই অবহেলিত। আমাদের পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলো যখন তাদের পর্যটন পণ্যের যথাযথ ব্যবহার করে এই শিল্পে উন্নতি করছে, বাংলাদেশে আমরা তখনো পর্যটন আদৌ শিল্প কি না, থাকলে এর আনুষঙ্গিক সুবিধাদির প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পর্যটনশিল্পে বাজেট বরাদ্দ, পর্যটনশিল্পে যথাযথ বিনিয়োগ নীতিমালা, পর্যটন আইনের সৃষ্টি এবং প্রয়োগ, স্টেকহোল্ডারদের প্রণোদনা দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেন-দরবারে ব্যস্ত।
আমাদের দেশে বর্তমানে পর্যটনশিল্পের যে ব্যাপক প্রসার হয়েছে, তার পেছনে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অবদানই সিংহভাগ—এ তথ্যটি কেউই অস্বীকার করবেন না আশা করি। কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, কুয়াকাটা, বান্দরবান, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া ও খুলনায় আজ যে স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছে, তার বেশির ভাগেরই মালিক বেসরকারি পর্যটন উদ্যোক্তারা। এমনকি সুন্দরবনে বেড়ানোর একক কৃতিত্বও কেবলই বেসরকারি উদ্যোক্তাদের—এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। দেশের পর্যটনশিল্প বিশেষ করে, বিদেশি পর্যটকদের এ দেশে নিয়ে আসার ব্যাপারে গুটিকয়েক ট্যুর অপারেটর যখন অক্লান্ত পরিশ্রম করে কাজ করে যাচ্ছে, ঠিক তক্ষুনি বিরোধী দল কর্তৃক আহূত এ জাতীয় হরতাল কর্মসূচিতে আমরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছি। বিদেশি পর্যটকেরা এ দেশে মূলত বেড়ানোর জন্যই আসেন। সে ক্ষেত্রে এ জাতীয় হরতালে হোটেলের বাইরে যাওয়া যায় না বলে তাঁরা ক্রমশ এ দেশে আসার ব্যাপারে উৎসাহী হন না।
এমনিতেই এ রকম একেকটি বিদেশি পর্যটক দলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে বছরের পর বছর যোগাযোগ করতে হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই তাদের আসার সম্মতি মেলে। কিন্ত এ রকম একেকটি রাজনৈতিক কর্মসূচিই তাদের নিরুৎসাহিত করতে যথেষ্ট। শুধু তাই নয়। যেহেতু এ জাতীয় হরতাল কর্মসূচি সাধারণত ঘোষণা করা হয়ে থাকে আগের দিন সন্ধ্যায়, সেহেতু পর্যটকদের আগে থেকে অবহিত করাও সম্ভব হয় না। ফলে হরতালে বিপাকে পড়ে পর্যটক, ভ্রমণ সংস্থাগুলো, সর্বোপরি দেশের বিকাশমান পর্যটনশিল্প। শুনতে হাসি পেলেও একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। বেশ কয় বছর আগে এমনি বারবার হরতালের ঘোষণায় বিরক্ত হয়ে ইংল্যান্ডের একটি বড় ট্যুর কোম্পানি, যারা বাংলাদেশে নিয়মিত সিরিজ ট্যুর পরিচালনা করে তারা আগামী এক বছরের হরতালের আগাম তারিখসহ তালিকা আমাদের কাছে চেয়েছিল। কারণ, তাদের ধারণা ছিল, এটি কোনো বার্ষিক ইভেন্ট ক্যালেন্ডারের মতোই কোনো নির্দিষ্ট কর্মসূচি। পরে আমাদের কাছ থেকে আসল তথ্য জানার পর তারা বেশ হতাশ হয়ে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম সীমিত করে নেয়।
এবারও বিরোধী দলের হরতালের রেশ পর্যটনশিল্পের ওপর পড়েছে। যার জন্য ভ্রমণ সংস্থাগুলো হরতালে গাড়ির সামনে বড় করে লাল কাপড়ে ‘বিদেশি পর্যটক’ লিখে এয়ারপোর্ট থেকে পর্যটকদের অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে হোটেলে পৌঁছে দিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু বিপাকে পড়তে হচ্ছে সিটি ট্যুর নিয়ে। যার জন্য পরিবেশবান্ধব রিকশা দিয়েই চলছে বিদেশিদের নিয়ে সিটি ট্যুর। কিন্তু এভাবে কি একটি শিল্প বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে যখন মাওবাদীদের দ্বারা চরম রাজনৈতিক সহিংসতা চলছিল, তখনো কিন্তু পর্যটকেরা ছিল নিরাপদে। রাস্তায় যখন ১৪৪ ধারা জারি ছিল, কোনো গাড়িঘোড়াও নজরে আসেনি, তখনো তারা পর্যটকবাহী যানবাহনকে এর বাইরে রেখেছিল। আর এতে করে পর্যটকেরাও বেশ স্বস্তিতে এবং নিরাপদ বোধ করেছিলেন। নেপালের কাছ থেকে এ বিষয়ে আমরা শিক্ষা নিতেই পারি।
তাই বিরোধী দলের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, দেশের পর্যটনশিল্প বিকাশের স্বার্থে হরতালের সময় দেশি-বিদেশি পর্যটকবাহী যানবাহনকে সংবাদপত্র, ওষুধ ও অ্যাম্বুলেন্সের মতোই হরতালের আওতামুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়ে পর্যটক এবং পর্যটনশিল্পকে সমুন্নত রাখতে বিশেষ অবদান রাখবে।
তৌফিক রহমান: উপদেষ্টা, ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)।
taufiq@journeyplus.com

No comments

Powered by Blogger.