নাচের মানুষ-প্রমার নৃত্যে জীবনের ছন্দ by এমিলিয়া খানম

অপরূপ দেহভঙ্গিমা আর নান্দনিক মুদ্রায় প্রমা অবন্তী যখন নাচেন তখন তাঁর সঙ্গে মিশে থাকে অন্তরের আবেগ। নৃত্য তাঁর কাছে শুধু কৌশল নয়, প্রাণের উচ্ছ্বাসও বটে। তাঁর নূপুরের ধ্বনিতে মানুষের সুখ-দুঃখও প্রতিধ্বনিত হয়। তাই তিনি বলেন, ‘নাচ আমার প্রতিদিনের প্রার্থনা। এটা আমার খুব প্রাণের বিষয়।’


২০ বছর ধরে ভরতনাট্যমের সঙ্গে জড়িত থাকলেও তিনি বলেন, ‘এখনো আমি প্রতিনিয়ত শিখছি। আমি স্বপ্ন দেখি নাচকে সহজ-সরলভাবে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার। বিশুদ্ধ ওডিশি ও রবীন্দ্রনাথের নাচের যে আলাদা একটা আঙ্গিক আছে তা সরল ও সুন্দরভাবে সবার মধ্যে উপস্থাপন করতে চাই।’
বাংলাদেশে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দীক্ষিত ওডিশি নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তী। ছোটকাল থেকে নৃত্যে হাতেখড়ি মামি সীমা বড়ুয়া ও গুরু রুনু বিশ্বাসের কাছে। ১৯৯১ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন (আইআরসিসিআর)-এর বৃত্তি নিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন প্রি-ডিগ্রিতে। এর আগে দেশে দু বছর ভরতনাট্যম শিখেছিলেন। একদিন রবীন্দ্রসদনে পদ্ম-বিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের ওডিশি নৃত্য দেখে সিদ্ধান্ত নেন ওডিশি নৃত্য শেখার। তারপর উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ওডিশি’ বিভাগে ভর্তি হন স্নাতকে। ওই বিভাগে ওডিশি শেখাতেন গুরু মুরলী ধর সীঝি। তাঁর কাছে তালিম নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে প্রথম হওয়ার পর রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে উদয়শংকর বৃত্তি প্রদান করে। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ নৃত্য আকাদেমি আয়োজিত আন্তবিদ্যালয় নৃত্য উৎসবে ‘ওডিশি নৃত্যে’র জন্য প্রথম হন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ নৃত্য আকাদেমি থেকে পান ‘চণ্ডীগড়’ বৃত্তি। পদ্ম-বিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের ‘সৃজনী’ প্রতিষ্ঠানে নাচ শেখার সুযোগ ঘটে সারা পশ্চিমবঙ্গ থেকে মাত্র দুজন শিক্ষার্থীর। সেখানে সুযোগ পান বাংলাদেশের প্রমা অবন্তী ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে ডোনা গাঙ্গুলী (সৌরভ গাঙ্গুলীর স্ত্রী)। প্রমা অবন্তী বলেন, ‘গুরুজির কাছে আমি তিন বছর নাচ শিখি। পাশাপাশি ওডিশি নৃত্যের ওপর তালিম পেয়েছি আরেক প্রতিভাবান নৃত্যশিল্পী প্রখ্যাত পাখোয়াজ বাদিকা গুরু পৌষালী মুখার্জির কাছে।’ এখনো তিনি গুরু পৌষালী মুখার্জির কাছে তালিম নিচ্ছেন।
প্রমা অবন্তী ওডিশি নৃত্যকে জনপ্রিয় করার জন্য প্রচার ও প্রসারে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। ইতিমধ্যে ওডিশি নৃত্যের জন্য সম্মানিত হয়েছেন—অনুশীলন সাংস্কৃতিক সংগঠন চট্টগ্রাম, আকৃতি নৃত্যকেন্দ্র ঢাকা, ওডিশি রিসার্চ সেন্টার ও ভুবেনশ্বর থেকে। উড়িষ্যা গত বছর বাংলাদেশ ও ভারতের ওডিশি নৃত্যে অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ নৃত্যমেলা—২০১১ তাঁকে শ্রেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী হিসেবে সম্মানিত করে। তিনি বলেন, ‘প্রতি ১০ বছর পরপর ওডিশি নৃত্যের জন্য “পৌষালী মুখার্জি ড্যান্স একাডেমি পশ্চিমবঙ্গ” সারা পৃথিবী থেকে একজন নৃত্যশিল্পীকে সম্মানিত করে। এই পুরস্কারটা আমার জন্য বিশাল সম্মানের। শুধু আমার নয় বাংলাদেশের জন্যও বটে।” বর্তমানে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে ও নাট্যকলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন নৃত্য শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। তা ছাড়া তিনি এখানে গড়ে তুলেছেন ওডিশি অ্যান্ড টেগোর ড্যান্স মুভমেন্ট সেন্টার। তাঁরই তত্ত্বাবধানে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী এখানে ‘ওডিশি’ ও ‘রবীন্দ্র নৃত্য’ শিখছে। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা, শাপমোচন পরিচালনা করেছেন। নৃত্যচর্চার পাশাপাশি অরিন্দমের জলকন্যা, তির্যকনাট্য গোষ্ঠীর নননপুরের মেলায় কমলা সুন্দরী ও একটি বাঘ আসে, উত্তরাধিকার নাট্যগোষ্ঠীর মৃত্যুপাখি নাটকে কোরিওগ্রাফি করেছেন এবং পোশাক পরিকল্পনা করেছেন গণায়নের মুক্তধারা নাটকের।
চট্টগ্রাম ধ্রুপদী নৃত্য শেখার খুবই সম্ভাবনাময় স্থান বলে মনে করেন প্রমা অবন্তী। এই চট্টগ্রামেই বিভিন্ন নাচের দক্ষ প্রশিক্ষক রয়েছেন। তবে কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার কথাও উল্লেখ করলেন তিনি। সরাসরি নাচের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র সংগত করার পর্যাপ্ত শিল্পীর অভাব রয়েছে এখানে। পাশাপাশি এই শিল্পের প্রতি পৃষ্ঠপোষকতা নেই এবং গণমাধ্যমগুলোর নজর নেই বলে অভিযোগ তাঁর। তবে এই বাধাকে বেশি বড় করে
কখনো দেখেন না তিনি। আর দেখেন না বলেই প্রবল মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন, নিজে শিখছেন আর তৈরি করছেন একঝাঁক নতুন শিল্পী। চট্টগ্রামে থেকেই এই শিল্পটার এমনভাবে বিকাশ ঘটাতে চান, যাতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাচের সুনাম ছড়িয়ে যায়।

No comments

Powered by Blogger.