স্মরণ-গ্রীষ্মের প্রতীক্ষায় by আজিজুস সামাদ আজাদ

মরহুম আব্দুস সামাদ আজাদকে নিয়ে কিছু লিখতে বসলে আমার মধ্যে একটা দুঃখবোধ কাজ করে। ওনার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে কতটুকুই আর জানি! আমার জন্মের দুই যুগ আগেই বাবার রাজনীতির শুরু। আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে এসেছেন সেই ১৯৪০ সালে, সুনামগঞ্জ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে।


আমার জন্মের পরও তাঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ খুব কমই হয়েছে। কারণ, উনি সময় কাটিয়েছেন হয় স্বৈরাচারের জেলে, নয়তো স্বৈরাচারের দৃষ্টির আড়ালে, আন্ডারগ্রাউন্ডে। আর বাকি সময় জনগণের মাঝে, জনগণকে সংগঠিত করার কাজে। বাবা নিজেও নিজের জীবনী লেখার ব্যাপারে খুবই অনাগ্রহী ছিলেন। ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে থাকাটাই ওনার বেশি পছন্দ ছিল।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে তিনি ব্রিটিশ সরকারের রুদ্ররোষে পড়েন এবং জেলে নিক্ষিপ্ত হন। তিনি সেই সামান্য কয়েকজন রাজনীতিবিদের মধ্যে একজন, যিনি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ—তিনটি দেশের জেলেই গিয়েছেন শুধু মানুষের অধিকার আদায়ের দাবি জানানোর কারণে।
শুধু ১৯৫৪ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সংসদীয় সরকারের প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে, একটি জেলার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের ভালোবাসা নিয়ে ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সাল। তখন সামাদ আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। সেই সভায় আব্দুস সামাদ আজাদ বললেন, ১৪৪ ধারা ভাঙতে পাঁচজনের সমাবেশই যথেষ্ট হলেও ১০ জন হলে নিজেদের শক্তিও বাড়ল, আবার আমরা কোনো অসাধারণ মিছিল-মিটিং করছি তা-ও নয়। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে সেটা হবে সাধারণ ছাত্রদের চলাফেরায় পুলিশের বাধা, হামলা, গুলি চালানোর শামিল। প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে প্রথম ১০ জনের মিছিলটি নিয়ে বের হয়ে আসেন আব্দুস সামাদ আজাদ।
ঔপনিবেশিক, স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দৃঢ় চারিত্রিক অবস্থান নেওয়ার কারণে তাঁর মাথার মূল্য নির্ধারিত হয়েছে তিনবার, সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক হয়েছে তিনবার। সব রকম লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে, কোনো রকম রাজনৈতিক স্খলন ছাড়া ৭০ বছর প্রগতিশীল রাজনীতির পতাকা উড়িয়ে বেড়ানোর মতো কজন মানুষ পাওয়া যাবে এই দেশে!
বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়, মুক্তিযুদ্ধ হিসেবেই পরিচয় করিয়ে দেওয়ার অন্যতম অংশীদার আব্দুস সামাদ আজাদ। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে গর্ববোধ করতেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যাঁরা জেল-জুলুম-মৃত্যুভয় আর ক্ষমতার লোভ উপেক্ষা করে কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন, তিনি তাঁদের একজন।
আব্দুস সামাদ আজাদ ছিলেন একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ এবং মজ্জাগতভাবে একজন প্রগতিশীল গণতন্ত্রী। প্রায় সারাটা জীবন বিরোধীদলীয় রাজনীতির অংশ হিসেবে থাকলেও রাজপথের পাশাপাশি আলোচনার টেবিলে তিনি ছিলেন দক্ষ। সে জন্যই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন দেশের একজন অন্যতম সেরা কূটনীতিবিদ হিসেবে। ’৮৩, ’৮৭ ও ’৯০-এর আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃত্ তিনি। সর্বদলীয় বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার-পদ্ধতির রূপরেখা প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
ভারত বিভাগের আগে থেকেই জ্যোতি বসু, আই কে গুজরালসহ জ্যেষ্ঠ ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা ছিলেন তাঁর বন্ধুস্থানীয়, সহকর্মী। আর এই দাবি নিয়েই ফারাক্কা বাঁধের পানি সমস্যার সমাধানকল্পে তিনি একটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ভারতের একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁর কথা ছিল একটিই—ভারত যদি নিজ দেশের এতগুলো ভাষা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য-ইতিহাসকে ধারণ করতে পারে, তবে অবশ্যই অন্য দেশের ভাষা-সংস্কৃতি, ঐতিহ্য-ঐতিহাসিক স্বকীয়তাকেও সম্মান করতে পারবে।
তবে ভারতের ব্যাপারে বাবার একটা দুশ্চিন্তা অনেক সময় কাজ করতে দেখেছি। সেটা হলো, ভারত যেভাবে নিজেকে ওই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত করছে, তাতে পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান যে ভুল করেছিল, একসময় ভারতও না সেই একই ভুল করে বসে। চীনকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে, মার্কিনকেন্দ্রিক বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে যদি নিজ দেশে মার্কিন সামরিক অবস্থানকে সুসংহত করে চীনকে দূরে ঠেলে দেয়, আর চীন যদি তৎকালীন ভারতীয় মনোভাব গ্রহণ করে, তবে অবশ্যই চীন তখনকার ভারতের মতো নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেবে না। চীন পূর্বমুখী হয়ে পড়বে। এতে ভারত হয়তো কিছুদিন আত্মতুষ্টিতে ভুগবে। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করে বলেছিলেন, শুধু ধর্মীয় কারণে উপমহাদেশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা আর মধ্যপ্রাচ্যে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একই উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহূত হবে। ঘটনাবহুল বিগত ৬০ বছর তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের উপমহাদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে।
এখন আমাদের জন্য মাওলানা আবুল কালাম আজাদও নেই, আব্দুস সামাদ আজাদও নেই। নেই মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতারা। আর বঙ্গবন্ধুর মতো ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব একটি জাতির ইতিহাসে আসে হাজার বছরে একবার। কে এখন আমাদের নিরাপদ দিকনির্দেশনা দেবেন? কই সেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ? কে এসে দুঃখের সময় আমাদের পাশে দাঁড়াবেন? কে দেবেন অভয়বাণী? ‘এক চড়ুইয়ের ডাকাডাকিতে গ্রীষ্ম আসে না’। সেই মহামতিদের তুলনায় আমরা অবশ্যই চড়ুইসম। আমাদের ডাকে গ্রীষ্ম আসবে না জেনেও আমাদের মতো কিছু চড়ুই কিচিরমিচির করেই যাবে, যাতে অন্য সব চড়ুই আমাদের এই ডাকাডাকির প্রার্থনায় যোগ দিয়ে কিচিরমিচির শব্দকে চিৎকারে রূপান্তরিত করে। কারণ, ঐতিহাসিক নিয়মে, প্রাকৃতিক নিয়মে গ্রীষ্ম একদিন আসবেই। তখন অন্তত জোর গলায় বলতে পারব, হে গ্রীষ্ম, তোমাকে পাওয়ার প্রার্থনায় আমরা ছিলাম। হে গ্রীষ্ম, তোমাকে বরণ করে নেওয়ার প্রতীক্ষায় আমরা ছিলাম। হে গ্রীষ্ম, তোমার উষ্ণতায় আমাদের সবাইকে তুমি উদ্দীপ্ত করো। সেই উত্তাপে আমরা সবাই মিলে একবার চিৎকার করে বলে উঠি, এ দেশ আমাদের দেশ।

No comments

Powered by Blogger.