শ্রদ্ধাঞ্জলি-রবীন্দ্রানুসারী কবি আ ন ম বজলুর রশীদ by তপন বাগচী

জন্মেছিলেন একই দিনে—২৫ বৈশাখ। একজন পা রাখলেন ১৫০-এ, আরেকজন ১০০-তে। একজন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), আরেকজন কবি-নাট্যকার আ ন ম বজলুর রশীদ (১৯১১-১৯৮৬)। দুজনই বহুমুখী। রবীন্দ্রনাথের উত্তরসাধক ছিলেন আ ন ম বজলুর রশীদ।


চিন্তা ও আদর্শের ক্ষেত্রেই নয়, কাজেও তিনি প্রমাণ রেখেছেন রবীন্দ্র-ভক্তি ও রবীন্দ্রানুরাগের। দেশে যখন রবীন্দ্র-বিরোধিতার ষড়যন্ত্র চলছিল, সেই সময়ে তিনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ (১৯৬১) নামের বই। ১৯৭২ সালে রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক আরেকটি বইয়ের ভূমিকায় তিনি এই অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন, ‘আমার রবীন্দ্রনাথ ১৩৬৮ সালের বৈশাখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সভয়ে আত্মপ্রকাশ করে। সভয়ে এ জন্য যে তখনকার পরিবেশ রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও জীবন-পরিচর্যার পক্ষে আদৌ অনুকূলে ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ওপর রচিত সেই সময়কালের প্রথম গ্রন্থটির একটি কপি উপহারস্বরূপ হাতে পেয়ে ঢাকা ইউসিসের প্রদর্শনীকক্ষে কবি সুফিয়া কামাল মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘আপনার সাহস তো কম নয়’’। কবি আহসান হাবীবও অনুরূপ উক্তি করেছিলেন।’ লেখক বইটির ‘সভয়ে আত্মপ্রকাশ’-এর কথা বলেছেন। এটি যে নিতান্তই সাহসী দায়িত্বশীলতা, তা আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না। তাই সুফিয়া কামাল ও আহসান হাবীবের মন্তব্যের পরে তাঁর আত্মমূল্যায়ন হচ্ছে, ‘...সে আমার সাহস নয়, আমার পক্ষে যা স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ আমি তাই করেছিলাম মাত্র।’ কিন্তু এই সাহসী কাজের জন্য যোগ্য প্রশংসাটুকুও তিনি পরবর্তীকালে লাভ করেননি।
রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ ও কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছিল, কতটা মুগ্ধতা সৃষ্টি করেছিল, তারই বিবরণ রয়েছে। গ্রন্থের ভূমিকাতেই সে কথা স্পষ্ট করা হয়েছে, ‘রবীন্দ্র-জীবন ও কাব্যের পটভূমি ও পরিবেশের পরিচয় দিতে যথাসাধ্য প্রয়াস পেয়েছি। আর, একদা ক্যালিফোর্নিয়ার পেলব বিচে বসে প্রশান্ত মহাসাগরের দিগন্ত-নীল দূর প্রশান্তি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেই প্রশান্তিও কিছুটা আনতে চেষ্টা করেছি। ... আর একটি কথা, intellectual study of a great man-এ আমি বিশ্বাসী নই।’
অগ্রজ কবির প্রতি অনুজ কবির শ্রদ্ধা ও প্রশস্তি প্রকাশের কারণে বইটি স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার। আ ন ম বজলুর রশীদের রবীন্দ্র-অধ্যয়ন আরেকটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের দেখে আসা স্থানগুলো ভ্রমণ করেছেন লেখক। বইয়ে সেই দেখার বিবরণ আছে। ইংরেজ ও পারস্যের কবিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের তুলনা করে রবীন্দ্র-মূল্যায়নে নতুন রসদ জুগিয়েছেন। রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে তাঁর রবীন্দ্র-ভাবনার যে প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তারই সম্প্রসারিত রূপ জীবনবাদী রবীন্দ্রনাথ (১৯৭২)। বইটির রচনার প্রেক্ষাপট ও প্রেরণা সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন, ‘১৯৪৮ সালের আশ্বিন মাসের কোনো এক অপরাহ্নে শান্তিনিকেতনের অতিথি-ভবনের সম্মুখদিককার বিমূর্ত-শিল্পের (কিউবিজমের একটি ফ্যানটাসটিক বা উদ্ভট রূপ—অবয়বের একটি মূর্তির) দীর্ঘ ছায়ারেখার নিচে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধেয় ক্ষিতিমোহন সেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কয়েকটি মূল্যবান কথা বলে মন্তব্য করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তোমাদের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন।... মন্তব্য করে ভক্ত ক্ষিতিমোহন আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়েছিলেন, বোধ হয় একটি প্রত্যাশিত উত্তরের আশায় ও অপেক্ষায়। হয়তো সে উত্তর এত দিনে দিতে পেরেছি বলে আমি কিছুটা আশ্বস্ত ও ভরমুক্ত হলাম।’
‘জানি না ফুরাবে কবে এই মধুরাতি’ সমর দাসের সুরে এই গানটি একসময় ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। জনপ্রিয় এই গানটি লিখেছেন আ ন ম বজলুর রশীদ। শিক্ষাবিদ হিসেবেও তিনি দেশের শিক্ষাবিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছন। শিক্ষার্থীদের পাঠচাহিদা পূরণে তিনি পাঠ্যপুস্তক রচনায়ও আত্মনিয়োগ করেছেন।
আ ন ম বজলুর রশীদ ১৯১১ সালের ৮ মে ফরিদপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম হারুনুর রশীদ আর মায়ের নাম নছিমুননেসা। তাঁর বাবা নদীয়া জেলায় তৃতীয় মুসলিম গ্র্যাজুয়েট। ফরিদপুর জিলা স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক মন্মথনাথ চক্রবর্তীর প্রেরণায় বজলুর রশীদ ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন। চার ক্লাস ওপরে পড়া কবি জসীমউদ্দীন সংশোধন করে দিতেন আ ন ম বজলুর রশীদের কবিতা। আবার জসীমউদ্দীন তাঁর বালুচর কাব্যের ভূমিকা লিখিয়েছিলেন বজলুর রশীদকে দিয়ে।
এমএ বিটি পাস করে তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে খণ্ডকালীন অধ্যাপক এবং ১৯৭৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পূর্ণকালীন অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার, ঢাকা বেতারের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার এবং পাকিস্তান সরকারের ‘তমঘায়ে ইমতিয়াজ’ উপাধি লাভ করেন।
কবির জন্মশতবর্ষ সামনে রেখে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। রচনাবলির পাশাপাশি তাঁর নির্বাচিত রচনার সংকলন প্রকাশ করা যেতে পারে। তাঁর নাটক নিয়ে উৎসব হতে পারে। সম্মান জানাতে পারে—ফরিদপুর শহরে একটি সড়কের নাম হতে পারে ‘কবি আ ন ম বজলুর রশীদ সড়ক’। সরকার তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দিয়ে সম্মান জানাতে পারে। তাঁর জন্মশতবর্ষ রাষ্ট্রীয় তথা জাতীয়ভাবে পালন করা যেতে পরে—তাতে কিছুটা হলেও এই কবির প্রতি মর্যাদা দিয়ে নিজেরা গৌরব বোধ করতে পারি।
বজলুর রশীদের নাটক সম্পর্কে নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘উত্তর ফাল্গুনী একটি উচ্চচিন্তার নাটক। কবিত্বপূর্ণ, দেশাত্মবোধমূলক এবং সমবায়ের আদর্শ উদ্বোধক। সংলাপ সর্বত্র মধুর ও মার্জিত। কোনো কোনো স্থলে অলঙ্কারমণ্ডিত রহস্যালাপের কৌশলময় ব্যবহারে নুরুল মোমেনী সার্থকতা অর্জন করতে পেরেছেন। যে সকল গান ও কবিতা নাটকে সংযোজিত করেছেন সেগুলোও নিজস্ব গুণে, সুরে, ছন্দ মনোমুগ্ধকর।’ মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যবোদ্ধার প্রশংসার পরে বজলুর রশীদের নাট্যপ্রতিভা নিয়ে কারও সংশয় থাকার কথা নয়।

No comments

Powered by Blogger.