সার্ধশত জয়ন্তী-রবীন্দ্রনাথ: স্মৃতিসত্তায় বাংলাদেশ by আহমদ রফিক

কথাটা নানা প্রসঙ্গে অনেকবার বলেছি, আবারও বলি, গ্রামবাংলার নিসর্গ-সৌন্দর্যের এমনই মায়া যে তা সংবেদনশীলচিত্তে নানামাত্রিক প্রভাব রাখে আর কবির বেলায় তো কথাই নেই। জন্মাবধি নাগরিক এবং আযৌবন নাগরিক পরিবেশে লালিত রবীন্দ্রনাথের বেলায় কথাটা গভীরভাবে সত্য।


আজ থেকে ১২০ বছর আগে নিছক জাগতিক প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথ প্রথম শিলাইদহ-সাজাদপুর-পতিসর অঞ্চলে এসেই এখানকার প্রকৃতির প্রেমে পড়ে গেলেন। আর হূদয় দিয়ে উপলব্ধি করলেন গ্রামীণ জীবন-জনপদের দুস্থ রূপ।
তাঁর মধ্যে জন্ম নিল ভিন্ন এক কবি, যার হাতে একদিকে আঁকা হলো গ্রামবাংলার রূপবৈচিত্র্য, অন্যদিকে দুস্থ গ্রামীণ জীবনের নানা রঙা ক্যানভাস। প্রমথনাথ বিশী ঠিকই বলেছেন, শিলাইদহ অঞ্চলে না এলে নাগরিক কবি রবীন্দ্রনাথ মহাকবি হয়ে উঠতে পারতেন না। আর রবীন্দ্রনাথও যে গ্রামীণ আবহে কতটা অভিভূত হয়েছিলেন, ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে তার বিস্তর সাক্ষ্য রয়েছে। ১৮৮৯ সালে শিলাইদহে পৌঁছে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ লেখেন, ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কি আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। শিলাইদহের অপর পারে প্রকাণ্ড চর ধূ ধূ করছে—... পশ্চিমে উঁচু পাড়, গাছপালা, কুটির, সন্ধ্যা সূর্যালোকে আশ্চর্য স্বপ্নের মতো’...। সান্ধ্য সৌন্দর্য সম্পর্কে কবির মুগ্ধ বয়ান, ‘আমার সর্বাঙ্গে নিস্তব্ধ প্রকৃতির কী একটা বৃহৎ, উদার বাক্যহীন স্পর্শ অনুভব করি’। অনুরূপ মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন পদ্মা প্রকৃতির গভীর মমতার স্পর্শ নিয়ে।
শুধু প্রাকৃত সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে থাকেননি রবীন্দ্রনাথ। জীবনযাত্রার রূপও লক্ষ করেছেন গভীর মমতায়। পদ্মাবোটে ভেসে চলতে চলতে দেখেছেন স্থানীয় জীবনের প্রাত্যহিক খণ্ড খণ্ড ছবি। নদীতে নৌকা চলছে, জেলেরা মাছ ধরছেন, নদীর ঘাটে ছেলেমেয়েরা নাইতে বা গৃহবধূরা জল নিতে এসেছে। অন্যদিকে চাষিরা ধান কেটে নৌকা বোঝাই করছেন। শূন্য আউশ ধান ও পাটের খেত, আকাশে বর্ষার সজল মেঘ—গ্রামবাংলার এমন সব ছবির বিশদ বিবরণ রয়েছে ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে। আর যে সোনার তরীতে করে কবি রবীন্দ্রনাথের এক ভিন্ন যাত্রা, সেই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় বিষয়টা স্পষ্ট করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
লিখেছেন: ‘বাংলাদেশের নদীতে নদীতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এর নূতনত্ব চলন্ত বৈচিত্র্যের নূতনত্ব।...অহরহ সুখদুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁচচ্ছিল আমার হূদয়ে।...সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাতে উন্মুখ করে তুলেছিল...বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্য সচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা। এ সময়কার প্রথম কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল সোনার তরীতে।’
এখানে সাহিত্য বলতে সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী অজস্র গানের পসরা, বিচিত্র প্রবন্ধ, কাব্যনাট্য এবং শিলাইদহ-পতিসর প্রভাবিত রচনাবলি। ছোটগল্পের সূচনা তো সাজাদপুরে। যে জন্য বলতে পেরেছেন, ‘আমার এই সাজাদপুরের দুপুরবেলা গল্পের দুপুরবেলা—মনে আছে ঠিক এই সময়ে আপনার মনে ভোর হয়ে “পোস্টমাস্টার” গল্পটা লিখেছিলুম।’ শুধু গল্পের ঝুলিই ভরে তোলেননি এ সময়ে, লিখেছেন ছড়াও। ওই একই চিঠিতে ছড়া সম্বন্ধে কথাও রয়েছে। ‘ছিন্নপত্রাবলী’ সাক্ষ্য দেয় রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকার ভাবনা এবং টুকিটাকি স্কেচ আঁকা শুরু এ অঞ্চলের প্রকৃতি-প্রভাবে। তাঁর নিসর্গ সিরিজের ছবিগুলো দেখলে তা বোঝা যায়, চেনা যায় শিলাইদহ-পতিসরের প্রকৃতিকে। ইছামতীতে ভেসে যেতে যেতে ১৮৯৪ সালে লেখা চিঠিতে আর্ট, ছবি, গান, সাহিত্য নিয়ে অনেক তত্ত্বকথা আর চারপাশের ছবির বর্ণনা কবি-শিল্পী রবীন্দ্রনাথকে চিনতে সাহায্য করে।
আর কর্মের কথা? গ্রামোন্নয়ন, আদর্শ পল্লিসমাজ গঠন, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প ইত্যাদি পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ডের সূচনাও শিলাইদহে, পতিসরে। দুস্থ কৃষক ও গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা ঘোচানো এবং স্বনির্ভর পল্লিসমাজ গড়ে তোলার স্বপ্নও এখানে জীবনবাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে। তাঁর ‘শ্রীনিকেতন’-এর প্রেরণা তো পতিসর, পতিসরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিপুল সাফল্য। এখানকার সাহিত্য সৃষ্টি ও মানবিক কর্মের কথা পরবর্তীকালে নানা প্রসঙ্গে বলেছেন, লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘কোপাই’-এ দেখেছেন পদ্মাকে। ‘ছিন্নপত্রাবলী’র পদ্মা-বন্দনার তুলনা মেলে না! রবীন্দ্রজীবনে পদ্মা ও সন্নিহিত নিসর্গের প্রভাব যেমন ব্যাপক, তেমনি গভীর। রবীন্দ্রনাথের শিল্প সৃষ্টির ভিন্ন এক উৎসমুখ খুলে দিয়েছিল পদ্মা ও তার সহচরী স্রোতধারা, পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির রূপলাবণ্য এবং জীবন-জনপদ। এর প্রমাণ মেলে এ পর্বে রচিত কবিতা, গান ও ছোটগল্পে।
রবীন্দ্রনাথ সাজাদপুরে প্রথম আসেন ১৮৯০ এবং পতিসরে ১৮৯১ সালে। সাজাদপুর যেমন তাঁর ছোটগল্পের ঝুলি ভরে দিয়েছে, তেমনি আত্রাই-নাগর নদে ভেসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন অনেক কবিতা। আর গান। অভিভূত হয়েছেন লোকসংগীত, বিশেষ করে বাউল গানের হূদয়ছোঁয়া গভীরতায়। আবার ‘হতশ্রী গ্রাম’, দুস্থ গ্রামের মানুষ তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে ‘দুই বিঘা জমি’র মতো কবিতা লিখতে। আর সেই সঙ্গে সমবায় ও ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের মাধ্যমে স্বনির্ভর মডেল গ্রাম গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রেরণা জুগিয়েছে।
নাগর নদের ঘাটে বসে ‘বিদায় অভিশাপ’ যেমন লিখেছেন, তেমনি পতিসরের প্রাকৃত সৌন্দর্য তাঁকে নিয়ে গেছে দূরে এক ভাববাদী কল্পনার জগতে। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথের শিল্পীজীবনের দুই বিপরীত প্রভাবের কথা—একদিকে ভক্তিবাদ-ভাববাদ, অন্যদিকে জীবনবাদী বাস্তবতা। এ দুই ধারারই প্রভাব এসেছে মধ্য ও উত্তরবঙ্গে বসবাসের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। সেসব কিছুটা জানা যায় তাঁর পত্রাবলীর সাক্ষ্যে, কিছুটা জানি তাঁর স্মৃতিচারণে—কথায় বা লেখায়।
শিলাইদহ থেকে ১৮৯৪ সালে এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমাদের দুটো জীবন আছে—একটা মনুষ্যলোকে আর একটা ভাবলোকে। সেই ভাবলোকের জীবনবৃত্তান্তের অনেকগুলি পৃষ্ঠা আমি এই পদ্মার উপরকার আকাশে লিখে গেছি। যখনি আসি এবং যখনি একলা হতে পাই তখনি সেগুলো চোখে পড়ে।’ এ ছাড়া বলেছেন, ‘বৃহৎ সর্বগ্রাসী, রহস্যময়ী প্রকৃতি’র কথা, যে গ্রামীণ প্রকৃতির প্রভাব রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মে, তাঁর তাত্ত্বিক ভাবনায়, তাঁর রোমান্টিকতায়, তাঁর বাস্তবিকতায় বিশাল প্রভাব রেখেছে।
সর্বোপরি যে গীতাঞ্জলি বাঙালির জন্য নোবেল পুরস্কারের সম্মান বয়ে এনেছিল, তার অনুবাদকর্ম শিলাইদহে পদ্মাসান্নিধ্যে বসেই সম্পন্ন করেছেন। শরীর-মন সুস্থ করে তুলতে পদ্মার প্রিয় সান্নিধ্য রবীন্দ্রনাথের জন্য ছিল অপরিহার্য। কথাটা তিনি একাধিক সূত্রে বলেছেন। আর বাংলা গীতাঞ্জলি ও গীতিমাল্যের বহু গান পদ্মার বাতাস উপভোগ করতে করতে লেখা, যেমন লেখা পতিসরে। আমাদের অবাক লাগে যখন পড়ি, শিলাইদহে বসে কবি উনিশ শতকের শেষ সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে আফ্রিকার বুয়রযুদ্ধে সাম্রাজাবাদী বর্বরতার বিরুদ্ধে অভিশাপবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, অবশ্য কবিতায়, ‘শতাব্দীর সূর্য আজ রক্তমেঘ মাঝে/ অস্ত গেল’ ইত্যাদি। এসব নিয়ে বিস্তারিত লেখার সুযোগ নেই।
তবে রবীন্দ্র-স্মৃতিবিজড়িত স্থান হিসেবে (২৫ বৈশাখের প্রয়োজনে) আমরা মূলত শিলাইদহ, সাজাদপুর, পতিসরকেই চিনি। কুষ্টিয়ার কথা বলি না। ভুলে যাই রবীন্দ্রনাথের দুবার ঢাকা শহরে আসার কথা। ময়মনসিংহ, আঠারোবাড়ি, শ্রীহট্ট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ কিংবা নাটোর, রাজশাহীতে যাওয়ার কথা। এগুলোকে স্মৃতিফলকে চিহ্নিত করা উচিত। তাঁর কনে দেখা উপলক্ষে দক্ষিণডিহিতে রবীন্দ্রনাথ একবারই গিয়েছিলেন। সেদিক থেকে দক্ষিণডিহির গুরুত্ব সামান্যই। অন্যদিকে উল্লিখিত স্থানগুলোতে রবীন্দ্রনাথ আতিথ্য গ্রহণ করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন, সমাজ-রাজনীতি-সংস্কৃতি সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তাভাবনার কথা বলেছেন। সেসবের গুরুত্বই আলাদা।
আহমদ রফিক: প্রাবন্ধিক, ভাষাসৈনিক।

No comments

Powered by Blogger.