গদ্যকার্টুন-প্রকল্পবিষয়ক প্রগলভতা by আনিসুল হক

গত মঙ্গলবার ‘ভাবিয়া করিও কাজ’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম অরণ্যে রোদন কলামে। তার বক্তব্য বিষয় ছিল, কারিগরি সমস্যার খুঁটিনাটি দিকগুলোর সমাধান ওই বিষয়ের বিশেষজ্ঞের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত, রাজনীতিকদের ওপরে নয়।


ওই লেখায় বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্প প্রণয়নের আগে কারিগরি সমীক্ষা, সম্ভাব্যতা যাচাই, অর্থনৈতিক লাভালাভ বিচার, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া, সর্বোপরি স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু ওই লেখায় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কোনো কথাই বলা হয়নি। আজকের গদ্যকার্টুনটা ওই লেখার ক্ষতিপূরণ।
আমাদের প্রকল্পগুলো প্রণয়নের পেছনে রাজনীতিকদের হঠাৎ করে বসে ঘোষণাই শুধু কাজ করে না, আসলে বড় প্রণোদনা থাকে দুর্নীতি, এই কথাটাই তো বলা হয়নি!
এই বিষয়ে যত কৌতুক জানি, তার সবই পুরোনো। পুরোনো কৌতুকগুলোই আবার বলা যায়, যদি প্রাসঙ্গিক হয়।
প্রথমেই ‘পুকুর চুরি’ কথাটা কোত্থেকে এল।
একটা প্রকল্প প্রণীত হয়েছে। একটা পুকুর কাটা হবে। যথারীতি এক কোটি টাকা বরাদ্দ হলো। ওই প্রকল্পের দায়িত্ব যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা পুরো টাকাটা মেরে দিলেন। পুুকুর কাটা হলো না।
তারপর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জানাল, তারা পরিদর্শক পাঠাচ্ছে। পুকুরটা কেমন হয়েছে, তারা সরেজমিনে দেখতে চায়।
কোনো পুকুরই তো কাটা হয়নি! এখন কী করা?
তখন তারা আবার একটা প্রকল্প প্রস্তাব পেশ করল তড়িঘড়ি করে। ওই এলাকায় পুকুরটি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি, চলাচলের পথে বাধা, সামাজিক নিরাপত্তার অন্তরায়। পুকুরটা বোজাতে হবে।
আবার এক কোটি টাকা বরাদ্দ হলো।
ওঁরা ওই টাকাটাও মেরে দিলেন।
তারপর পরিদর্শক এলেন। এসে দেখলেন, পুকুরটা সুন্দরভাবে ভরাট করা হয়েছে। কাজটা এত সুন্দর হয়েছে যে বোঝারই উপায় নেই এখানে আগে কখনো কোনো পুকুর ছিল।
বাংলাদেশের নেতা বেড়াতে গেলেন চীনে। চীনা নেতা তাঁকে তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িতে নিয়ে গেলেন। কী সেই বাড়ির শানশওকত! কী খানাপিনা। বাংলাদেশের নেতা অভিভূত! চীনের নেতা বললেন, ওই জানালা দিয়ে দেখো একটা সেতু। দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ।
আমার সমস্ত সৌভাগ্যের মূলে ওই সেতুটা। এই যে বাড়ি, গাড়ি, শানশওকত—এগুলো এসেছে এই সেতু বানানোর বাজেটের টেন পারসেন্ট থেকে।
চীনের সেই নেতা এলেন বাংলাদেশে বেড়াতে। বাংলাদেশের নেতা তাঁকে নিজের বাড়িতে দাওয়াত করলেন। চীনা নেতার চক্ষু চড়কগাছ। কী বাড়ি! কী তার লন! গ্যারাজে সব দামি দামি গাড়ি। সুইমিংপুল। টেনিস কোর্ট।
চীনের নেতা বললেন, তোমাদের দেশ তো গরিব। তোমাকে বেতন কত দেয়? তুমি কীভাবে এত কিছু করলে? এই বাড়ি, গাড়ি?
বাংলাদেশের নেতা বললেন, ওই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখো। ওই যে নদীর ওপরে। কিছু দেখতে পাচ্ছ?
না তো। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
কী করে দেখবে? কিছু থাকলে তো দেখতে পেতে। ওখানে একটা সেতু হওয়ার কথা ছিল। তার বাজেটের ফিফটি পারসেন্ট দিয়ে এই বাড়ি-গাড়ি, সুইমিংপুল...
ফিফটি পারসেন্ট! বাকি ফিফটি পারসেন্ট কী হলো?
সেকি! আমাকে তুমি নৈতিকতাবিরোধী কাজ করতে বলো? হানড্রেড পারসেন্ট আমি একা খাব! আর লোকজন আছে না! তাদেরকে তাদের শেয়ার পৌঁছে দিতে হয় না! আমরা অত খারাপ নই।
তাই তো! আমরা কি অত খারাপ? আমরা কি ‘শুয়োরের বাচ্চা’?
আকবর আলি খানের পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটায় আছে এই ‘শুয়োরের বাচ্চা’ প্রসঙ্গ! আসানসোলে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন মাইকেল ক্যারিট সাহেব। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, এক পাঞ্জাবি ঠিকাদার তাঁকে বলেছিল, এই দুর্ভাগা দেশে তিন কিসিমের লোক আছে। যারা সজ্জন, যারা ঘুষ খায় না। আছে বদলোক, যারা ঘুষ খায়। আর আছে শুয়োরের বাচ্চারা, যারা ঘুষ খায়, কিন্তু ঘুষ প্রদানকারীকে কোনো প্রকার সাহায্য করে না।
ব্রিটিশ আমলে হয়তো এই তিন রকমেরই লোক ছিল। এর মধ্যে আরেক রকম লোক দেখা দিয়েছে আমাদের দেশে। কোনো একটা কাজের জন্য তারা সব পার্টির কাছ থেকেই ঘুষ নেয়। তারপর যাদের কাজ হয়, তাদেরটা তারা রেখে নেয়। বাকিটা ফেরত দিয়ে দেয়। এদের এই যে উচ্চ নৈতিকতাবোধ, এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার।
তবে, আসলে নাকি এদের কোনো ক্ষমতাই নেই। তবু এদের ক্ষমতা আছে ভেবে লোকেরা ঘুষ জোর করে দিয়ে যায়। আর ওরা যদি বলে, ব্যাপারটা তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত, তাহলে এলাকায় তাদের দাম কমে যায়। এ জন্য তারা সবার কাছেই টাকা খায়। এর মধ্যে কারও কারও কাজ আপনাআপনিই হয়ে যায়। তখন সেই টাকাটা রেখে বাকিটা ফেরত দেয়। উভয়েই খুশি। এদের কী বলে ডাকব? পুরো মানবও নয়, পুরো বরাহও নয়। এদের নাম দিতে পারি ‘মানবরাহ’।
দুর্নীতি এই দেশে বড় সমস্যা। কিন্তু আরও একটা সমস্যা আছে। তা হলো অদক্ষতা। একটা লোক কাজ পারে না, কিন্তু সৎ। আরেকটা লোক কাজ পারে, কিন্তু অসৎ। এই দুজনের মধ্যে কোনটা ভালো। আমরা বলব, কেউ ভালো না। আমরা সৎ মানুষও চাই, দক্ষ মানুষও চাই। কিন্তু ওই যে সোনার পাথরবাটি। বঙ্গধামে বিরাজ করে না। এবার কী করবেন?
আচ্ছা, প্রশ্নটা সহজ করে আনি। আপনার গাড়ির জন্য আপনি ড্রাইভার নিয়োগ দেবেন। একজন আছে, সে আপনার গাড়ির তেল চুরি করবে, কিন্তু সে গাড়িটা ভালো চালায়। আরেকজন গাড়িটা চালাতে পারে না, খুবই আশঙ্কা আছে, তার হাতে গাড়ি দিলে আপনি দুর্ঘটনার শিকার হবেন। আর কোনো প্রার্থী নেই। আপনি কী করবেন?
আপনি ধাঁধায় পড়ে গেছেন। বেশি ভাবতে হবে না। আপনার জন্য এত কিছু চয়েস নেই। একটাই চয়েস আছে। যে গাড়িও চালাতে পারে না, আবার সে দুর্নীতিবাজ ও চরিত্রহীন। তার আচার-ব্যবহারও ভালো না। তাকেই আপনার গাড়ি চালাতে দিতে হবে। বাধ্যতামূলক। আপনার সামনে কোনোই বিকল্প নেই।
লেখাটা বেশি গুরুগম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। একটা কৌতুক বলে শেষ করি। একজন যাজক, আরেকজন মিনিবাসের চালক—এ দুজনের মধ্যে কে স্বর্গে যাবে?
মিনিবাসের ড্রাইভার।
কেন?
কারণ যাজক যখন আলোচনা করতেন, তখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ত। আর চালক যখন মিনিবাস চালাত, যাত্রীরা সবাই ঈশ্বরকে ডাকত।
আসুন, আমরা সবাই ওপরওয়ালাকে স্মরণ করি। তাঁর শরণ নিই।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক, সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.