মিডিয়া ভাবনা-রবীন্দ্রচর্চার নানা দিক by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। কলকাতার সাহিত্যমনস্ক ব্যক্তিদের ধারণা, ‘পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা (প্রধানত গান) ও রবীন্দ্রপ্রেম অনেক বেশি।’ এর জন্য কিছুটা ‘কৃতিত্ব’ দিতে হয় অবিভক্ত পাকিস্তানের একনায়ক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান ও তাঁর তাঁবেদার গভর্নর মোনেম খানকে।


তাঁরা সেকালে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রসংগীত ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতা না করলে পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এভাবে শিক্ষিত মানুষের কাছে পরিচিত ও প্রিয় হয়ে উঠতেন না। রবীন্দ্রনাথ একজন মহাকবি হিসেবে সাহিত্যবোদ্ধা, সাহিত্যিক ও সংগীতশিল্পীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতেন। ভাগ্যিস সেকালে আইয়ুব-মোনেম চক্র রবীন্দ্রনাথ ও বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধিতায় নেমেছিল!
এটা আমার অনুমান। তা সত্য নাও হতে পারে। রবীন্দ্র-বিরোধিতা না হলেও রবীন্দ্রনাথ ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা হয়তো লাভ করতেন। এটা নিয়ে তর্ক হতে পারে, তবে পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায় বর্তমানকালে রবীন্দ্রনাথের যা অবস্থান বা জনপ্রিয়তা, তা দেখে আমার অনুমানটিই সত্য বলে মনে হতে পারে। তুলনামূলকভাবে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ সাহিত্যপ্রীতি, সাহিত্যপাঠ, বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও সংগীতচর্চায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে। এর জন্য নানা ঐতিহাসিক কারণ দায়ী। পূর্ববঙ্গ তথা ঢাকার শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা শুরু হয়েছে অনেক দেরিতে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর সাড়ম্বরে ২৫ বৈশাখ রবীন্দ্র জন্ম দিবস ও ২২ শ্রাবণ রবীন্দ্র প্রয়াণ দিবস পালিত হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ২৫ বৈশাখ সরকারিভাবে পালিত হয়। অবশ্য এ রীতি চালু করে গেছেন এইচ এম এরশাদ। বিএনপি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তেমন আগ্রহ দেখায়নি।
রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করা বা রবীন্দ্রচর্চা করার কয়েকটি দিক রয়েছে। যেমন, ১) সরকারি উদ্যোগ, ২) বেসরকারি উদ্যোগ, ৩) ব্যক্তি উদ্যোগ। এ নিবন্ধে তিনটি দিক নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
১) সরকারিভাবে রবীন্দ্র পৃষ্ঠপোষকতার তেমন বড় কোনো দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ও শাহজাদপুরে কাছারিবাড়ি সংরক্ষণ সরকারের দুটি বড় কাজ বলে আমি মনে করি। এ দুটি জায়গায় গিয়ে দেখেছি, ভবন দুটি মোটামুটি ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। হয়তো আরও কিছু করার সুযোগ ছিল। কিন্তু যেটুকু করা হয়েছে, তা সরকারি কাজ হিসেবে উল্লেখ করার মতো। এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনও প্রশংসার দাবিদার।
সরকার যদি রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আগ্রহী হয় এবং গবেষকদের রবীন্দ্রচর্চায় উৎসাহিত করতে চায়, তাহলে সরকারকে আরও কিছু কাজ করতে হবে। শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে রবীন্দ্র-অনুরাগী ব্যক্তি বা গবেষকেরা যেন নিয়মিত যেতে পারেন ও থাকতে পারেন, সে জন্য এ তিনটি জায়গায় সরকারি উদ্যোগে তিনটি গেস্টহাউস ও ডরমেটরি নির্মাণ করলে ভালো হয়। এসব জায়গায় পর্যটকদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা (নিজ খরচে) থাকলে দেশের বিভিন্ন এলাকা (অন্তত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে আগ্রহী ব্যক্তিরা এসব স্থান পরিদর্শন করতে আসবেন। ‘মানুষের ঢল নামবে’ তা আমি দাবি করছি না, তবে থাকার সুব্যবস্থা ও নিরাপত্তা থাকলে এবং তা বিজ্ঞাপিত হলে অনেক মানুষ আগ্রহী হবেন।
রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত এ তিনটি স্পট সম্পর্কে আমরা কলকাতা, শান্তিনিকেতন তথা পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার রবীন্দ্র-অনুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। ২৫ বৈশাখ উপলক্ষে পর্যটন, রেলওয়ে বা ‘বিমান’ প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করতে পারে। আমার ধারণা, কলকাতা ও আগরতলায় যথাযথ বিজ্ঞাপিত হলে এসব প্যাকেজ ট্যুরে অনেক ভারতীয় বাঙালি আগ্রহী হবেন। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তুলনা করছি না, তবে ‘পশ্চিমবঙ্গ ট্যুরিজম’ শান্তিনিকেতন ও পৌষমেলাকে বেশ ভালোভাবেই বিজ্ঞাপিত করে। আমাদের দেশে যে তিনটি রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত স্পট রয়েছে, তা আমাদের কোনো সরকারই বিজ্ঞাপিত করতে পারেনি। সরকার শুধু আগ্রহী ২৫ বৈশাখের গান-বাজনা ও বক্তৃতায়। এসব ক্ষেত্রে অনুষ্ঠান ছাড়া সরকারকে (সব আমলে) অন্য কাজে কোনোভাবেই আগ্রহী করা যায় না। আমার মতে, মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠান কমিয়ে দেওয়া উচিত। মন্ত্রণালয় নীতি ঠিক করে দেবে ও ফান্ড দেবে। অনুষ্ঠান করবে মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রী ও সচিবের অনুষ্ঠানের মঞ্চে না যাওয়াই ভালো। গেলেও যাবেন দর্শক হিসেবে। বইমেলা, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লোকনাট্য, চিত্রকলা ইত্যাদি প্রসঙ্গে মন্ত্রীদের বক্তৃতা বড্ড মেকি মনে হয়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের জ্ঞান যে সীমাবদ্ধ, তা কারও অজানা নয় (ব্যতিক্রম ছাড়া)। কাজেই মাননীয় মন্ত্রীরা যদি তাঁদের বদলে বিষয়-বিশেষজ্ঞদের ‘প্রধান অতিথি’ হতে উৎসাহিত করেন, তাহলে আমাদের অনুষ্ঠান-সংস্কৃতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন আসবে। আমার ধারণা, এতে মন্ত্রী প্রশংসিতও হবেন।
প্রতিবছর রবীন্দ্র বা নজরুলজয়ন্তীতে সরকার এমন একটা ঘোষণা দিতে পারে, যার প্রভাব হবে দীর্ঘস্থায়ী। অনুষ্ঠানের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয় না। রবীন্দ্র বা নজরুলজয়ন্তীর অনুষ্ঠান নিয়ে মন্ত্রী, সচিব বা মন্ত্রণালয় যেন ব্যস্ত হয়ে না পড়ে। অনুষ্ঠান করা খুব সহজ কাজ। একটা ক্লাবও এটা করতে পারে। তবে হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের ১৪৯তম জন্মবার্ষিকীর মতো অনুষ্ঠান হলে সেটা ভিন্ন কথা। তা সে রকম অনুষ্ঠান তো ১০০ বছরে চারটিই হবে!
শুনেছি এ বছর থেকে সরকার বাংলা একাডেমীর মাধ্যমে ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ দেবে। খুব ভালো উদ্যোগ। রবীন্দ্র-সাহিত্যের গবেষক, রবীন্দ্রসংগীতচর্চা ও শিক্ষকতায় দীর্ঘদিন যাবৎ অবদান রেখে চলেছেন, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি নিয়ে নানা কাজ করেছেন, এমন ব্যক্তিদেরই এ পুরস্কার দেওয়া হবে বলে আশা করা যায়।
সরকার প্রতিবছর একটা রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ, চলচ্চিত্র ও গানের সিডিকে পুরস্কৃত করতে পারে বাংলা একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমীর মাধ্যমে। এটা হতে পারে বাৎসরিক মূল্যায়ন। রবীন্দ্র পুরস্কার হবে আজীবন সাধনার পুরস্কার। এসব পুরস্কার ও স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশে রবীন্দ্রচর্চা উৎসাহিত হবে। তা না হলে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীদের বহু শ্রুত ২৫টির মতো গান পরিবেশনই হবে প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ উদ্যাপন। এতে কোনো বৈচিত্র্য থাকবে না। সংগীতশিল্পী ছাড়া অন্যরা রবীন্দ্রচর্চায় পৃষ্ঠপোষকতা বা উৎসাহ পাবেন না।
বাংলা একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমী প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ একটি নতুন বই বা সিডি প্রকাশ করতে পারে। ২৫ বৈশাখের অনুষ্ঠানে সেই বইয়ের মোড়ক উন্মোচিত হবে। লেখক বা শিল্পীকে সম্মানিত করা হবে। লেখক বা শিল্পীও বসবেন অনুষ্ঠানের মঞ্চে।
তথ্য মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’-এর মাধ্যমে দেশের কৃতী পরিচালকদের আমন্ত্রণ করে বছরে একটি রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকে টেলিফিল্ম প্রযোজনা করতে পারে। ‘বিটিভি’ প্রযোজিত মুস্তাফা মনোয়ারের রক্তকরবী নাটক এখনো খ্যাতির শীর্ষে। তাঁর পরিচালনায় স্ত্রীর পত্রও একটি অসাধারণ প্রযোজনা। অপ্রিয় হলেও বলতে বাধ্য হচ্ছি, রবীন্দ্র-সাহিত্য থেকে নাটক প্রযোজনা করা সবার উচিত নয়। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রবীন্দ্র-ছোটগল্পের যে নাট্যরূপ দেখি, তা খুবই করুণ (ব্যতিক্রম কম)। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। কাজেই প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তাই বিটিভিকে এ দায়িত্ব পালন করতে অনুরোধ করি। আমাদের মান-সূচক হবে রক্তকরবী। এর নিচে নয়।
প্রায় ১০ বছর আগে একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম। সেখানকার এক প্রবীণ অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার যেন শান্তিনিকেতনে একটা “বাংলাদেশ ভবন” নির্মাণ করে দেয়। যে ভবনে থাকবে বাংলাদেশে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক বই, গানের ক্যাসেট, সিডি, নাটকের ডিভিডি। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীরা যেন এই ভবনে গবেষণা বা পড়াশোনা করার সুযোগ পায়।’ আমার কাছে দারুণ মনে হয়েছে প্রস্তাবটি। বাংলাদেশ সরকার (সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়) প্রস্তাবটি বিবেচনা করতে পারে।
আমি মনে করি, সরকার রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু করতে চাইলে এভাবে কাজ করতে পারে। অনুষ্ঠান ও বক্তৃতা দেওয়ার জন্য সরকারের প্রয়োজন নেই। সরকার করবে বড় মাপের কাজ।
২) বেসরকারিভাবে কেউ কেউ রবীন্দ্রচর্চায় দীর্ঘদিন কাজ করে যাচ্ছে। যেমন, ‘ছায়ানট’। সরকার ছায়ানট ভবনের জন্য জমি দিয়ে প্রশংসনীয় কাজ করেছে। এ রকম যারা রবীন্দ্রচর্চায় নিবেদিত, মন্ত্রণালয় তাদের বাৎসরিক একটা বিশেষ অনুদান দিতে পারে।
বিভিন্ন প্রকাশক কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ-বিষয়ক বই (নির্বাচিত) কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরি ক্রয় করে দেশের সব পাবলিক লাইব্রেরিতে পাঠাতে পারে।
৩) ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকে রবীন্দ্রচর্চা করেন। গান করেন। গবেষণা করেন। লেখালেখি করেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা সর্বজনস্বীকৃত, পর্যায়ক্রমে তাঁদের রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত করা যায়।
কেউ কেউ রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন। আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের নামে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে, তবে তা কোনোভাবেই রবীন্দ্রচর্চার জন্য নয়। তবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র’ নামে একটি ইনস্টিটিউট থাকলে নামকরণের সার্থকতা হয়। শাহজাদপুর বা পতিসরে যে স্থানে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা রয়েছে, এ বিশ্ববিদ্যালয়টি সেই স্থানে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। স্থান নির্বাচনটা যেন রাজনৈতিক বিবেচনায় না হয়।
আমার লেখার সারকথা হলো, বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার জন্য অনেক কাজ করা হয়েছে। ২৫ বৈশাখ সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করার মধ্যে যেন আমাদের প্রয়াস সীমিত না রাখি। বিশেষ করে সরকারের এ ব্যাপারে বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। আগামী বছর রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা যেন দীর্ঘস্থায়ী কিছু কাজের সূচনা করতে পারি।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.