বকেয়া কর ফেরত দেওয়ার নতুন কৌশল ডেসটিনির by ফখরুল ইসলাম

ডেসটিনি গ্রুপের ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি খতিয়ে দেখছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কর ফাঁকির তদন্ত করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। আর ডেসটিনির মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি তদন্ত দল গঠন করে তা খতিয়ে দেখছে।


এই যখন পরিস্থিতি, তখন পাওনা পরিশোধের নামে ভিন্ন এক কৌশল নিয়েছে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ। ১৩ মে ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৩৭টি আলাদা আবেদন করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে। বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে এসব আবেদন করেছেন ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল আমীন।
আবেদনে বলা হয়েছে, ডেসটিনি গ্রুপের কাছে কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক), ফি বা অন্য যেকোনো ধরনের পাওনা থাকলে ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ তা পরিশোধ করে দিতে চায়। আবেদনে ডেসটিনি গ্রুপের কাছে সরকারের পাওনার পরিমাণ কত, তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেন ডেসটিনির কাছে সরকারের পাওনার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয়।
এক সপ্তাহ পর গতকাল সোমবার ডেসটিনি গ্রুপকে তাদের আবেদনের জবাব পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, পাওনা নির্ধারণ করে দেওয়ার বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। রফিকুল আমীনকে উদ্দেশ করে পাঠানো চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ডেসটিনি যেসব খাতে ব্যবসা করে, সেসব খাতে নিশ্চয়ই সরকারের পক্ষ থেকে কর, মূসক ও ফি নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। সে অনুযায়ী সব ধরনের পাওনা পরিশোধ করা ডেসটিনি কর্তৃপক্ষেরই দায়িত্ব। এতে আরও বলা হয়, সব ধরনের পাওনা গ্রহণের জন্য সরকারের আদায়কারী সংস্থা রয়েছে। ডেসটিনি চাইলে সেসব সংস্থায় যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে।
কমিশন গঠন ঠেকানোর চেষ্টা!: অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ এখন কমিশন গঠন ঠেকানো নিয়ে সরকারের নানা দপ্তরে চেষ্টা করছে। জানা গেছে, সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন দুই কর্মকর্তার সঙ্গে ডেসটিনির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে।
এদিকে, ডেসটিনি নিয়ে কমিশন গঠনের কথা থাকলেও তা গঠিত না হলে ডেসটিনির সম্পদ হস্তান্তর বা বিক্রি হয়ে যাবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কিত অর্থমন্ত্রী। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে অর্থমন্ত্রী তা জানতে চেয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুদককে তথ্য দিচ্ছে না ডেসটিনি: ‘ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অননুমোদিত ব্যাংকিং, দুর্নীতি, প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহসহ মানি লন্ডারিং’ শীর্ষক ৩৮ ধরনের তথ্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গতকাল সোমবার।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তিন দফা সময় নিয়েও ডেসটিনি কর্তৃপক্ষ দুদকে গতকাল তা দাখিল করেনি। বারবার সময় দিয়েও তথ্য না দেওয়ায় দুদক এখন ডেসটিনির বিরুদ্ধে ভিন্ন ব্যবস্থা নেবে বলে ডেসটিনিবিষয়ক দুদক তদন্ত দলের একজন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন।
গত ১৬ এপ্রিল এক সপ্তাহের সময় দিয়ে ডেসটিনির কাছে ‘অতি জরুরি’ ভিত্তিতে তথ্য চেয়েছিল দুদক। তথ্যগুলো হলো: ডেসটিনি ২০০০ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোতে জন্মলগ্ন থেকে এ পর্যন্ত কত টাকা জমা হয়েছে, পরিবেশকদের এ পর্যন্ত কত টাকা কমিশন দেওয়া হয়েছে, ডেসটিনি কোন কোন দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, পাউলিনিয়া বৃক্ষরোপণের নামে কত টাকা মানুষের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে এবং এই টাকা এখন কোথায় আছে, কোন দেশ থেকে চারা আমদানি করা হয়েছে, প্রকল্পের জায়গাসহ গাছের সংখ্যা কত ইত্যাদি।
এ ছাড়া, পরিচালকেরা এ পর্যন্ত কত টাকা সম্মানী পেয়েছেন, তাঁদের বিদেশ ভ্রমণে কত টাকা খরচ হয়েছে, ডেসটিনি ২০০০-এর উপপরিচালক আশরাফুল আমীনসহ শাম্মী আক্তার ও মিম্মি আক্তারের ব্যাংক হিসাবে কত টাকা আছে, বেস্ট এয়ারের যাবতীয় তথ্য, বিদেশি নাগরিকেরা কত টাকা বিনিয়োগ করেছেন এবং কত টাকা তাঁদের লভ্যাংশ দেওয়া হয়েছে ইত্যাদি বিষয়েও জানতে চায় দুদক।
ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল আমীন গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, দুদক অনেক বেশি পরিমাণ তথ্য চেয়েছে অল্প সময় দিয়ে, যা ডেসটিনির পক্ষে দেওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া কিছু তথ্য ডেসটিনির হাতে নেই, সংগ্রহ করে দিতে হবে। এ জন্য সময় দরকার। সময় বাড়িয়ে দিয়ে দুদক ১৩ মে যে চিঠি পাঠিয়েছে, তা গতকাল সোমবার তিনি পেয়েছেন বলে জানান।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে পাওনা পরিশোধের আবেদন কেন, জানতে চাইলে রফিকুল আমীন বলেন, ‘আমরা অনেক জায়গাতেই আবেদন করেছি। সে হিসেবেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে করেছি।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা জানান, ডেসটিনি আবেদন করেছে এটা দেখানোর জন্য যে, পাওনা পরিশোধের জন্য নিজে থেকেই আগ্রহী তারা। এটি একটি নতুন কৌশল বলে তিনি মন্তব্য করেন।

No comments

Powered by Blogger.