কালের পুরাণ-‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অথবা মূর্খতাপ্রসূত পরিসমাপ্তি’? by সোহরাব হাসান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর জন্য ‘গণতন্ত্র-সনদ’ বা চার্টার অব ডেমোক্রেসি প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। উন্নয়নের সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রশ্নটি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। একসময় দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে সামরিক শাসন, রাজতন্ত্র ও একনায়কতন্ত্র জেঁকে বসেছিল।


১৯৮৫ সালে ঢাকায় সার্কের সূচনাকালেও বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে সামরিক শাসন বহাল ছিল। নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে গণতন্ত্রায়ণ সাম্প্রতিক ঘটনা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ উন্নয়ন-প্রক্রিয়ায় নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে, স্বৈরতন্ত্রে সবকিছু ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ—সার্কের সদস্য আটটি দেশেই এখন নির্বাচিত সরকার রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার প্রস্তাবটি ব্যাপক আলোচনার দাবি রাখে। এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিকল্প নেই। তবে আমরা এও জানি, গণতন্ত্রই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখার একমাত্র চাবিকাঠি নয়। দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্কোন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো, ‘দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে’। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ভৌগোলিক আয়তন বড় অদ্ভুত। এখানে ভারতের মতো বিশাল দেশ যেমন আছে, তেমনি আছে মালদ্বীপ ও ভুটানের মতো ছোট দেশও। ছোট ও বড় দেশের মধ্যকার স্বার্থের দ্বন্দ্বে বড় দেশকে কিছুটা ছাড় দিতে হয়। ভারত বা পাকিস্তান তা দিতে রাজি আছে কি না, তার ওপরই সার্কের সাফল্য ব্যর্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আঞ্চলিক ‘গণতন্ত্র-সনদ’ প্রণয়নের কথা বলে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রগতি, স্থিতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিকে এক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, তা বিপুলভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি থিম্পুতে যখন এ প্রস্তাব দেন, তখনই থাইল্যান্ডের রাজপথে আন্দোলনকারী জনগণ ও সেনাবাহিনী মুখোমুখি অবস্থান করছিল (এখনো আছে)। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যকার বিরোধই দেশটিকে গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। লাগাতার আন্দোলন-ধর্মঘটের প্রেক্ষাপটে থাই প্রধানমন্ত্রী আগামী নভেম্বরে নতুন নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন, তাও এক ধরনের আপস প্রস্তাব। চার বছর আগে দেশ থেকে বিতাড়িত থাকসিনকে সে দেশের মানুষ আবার বরণ করে নিতে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হরহামেশা এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এ থেকে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদেরও শেখার আছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি থাইল্যান্ড তো বটেই, এমনকি পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার চেয়েও দুর্বল। দেশকে স্থিতিশীল রাখতে বা উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিতে সরকার ও বিরোধী দলসহ ক্ষমতার বলয়ে অন্তর্ভুক্ত সব পক্ষের ন্যূনতম মতৈক্যে পৌঁছানো প্রয়োজন; তাকে আমরা যে নামেই ডাকি না কেন।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র-সনদের ধারণা নতুন নয়। নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে পাঁচ দল—এই তিন জোট মিলে যে পাঁচ দফা রূপরেখা তৈরি করেছিল, দেশবাসী তাকে ‘গণতন্ত্র-সনদ’ হিসেবেই মেনে নিয়েছিল। এ সনদের মূল কথা ছিল সার্বভৌম জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন চালু এবং বেতার-টিভির স্বায়ত্তশাসন। যদিও পরবর্তীকালে নির্বাচিত সরকারগুলো সেই সনদ মানেনি। ১৯৯১ সালে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির স্থলে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো কোনো বিষয়ে একমত হতে পারেনি। এমনকি বহুলালোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বিএনপি এমনভাবে করেছিল, যাতে রাষ্ট্রপতিই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থাকেন, যার সকরুণ পরিণতিও আমরা দেখেছি।
দেশের বর্তমান ভঙ্গুর, দুর্বল ও প্রায় ন্যুব্জ গণতন্ত্রকে বাঁচাতে অবিলম্বে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ন্যূনতম সমঝোতা বা কর্মসম্পর্ক থাকা জরুরি। তারা এমন কিছু করবে না, যাতে আবার ১/১১-এর মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। ১/১১-এর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অপরকে যতই দোষারোপ করুক না কেন, সে সময়ে অস্বাভাবিক শাসন জেঁকে বসেছিল তাদের ব্যর্থতা ও সংঘাতের কারণেই। ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে কতগুলো মৌলিক বিষয়ে একমত হতে হবে। প্রস্তাবিত সেই গণতন্ত্র-সনদের রূপরেখা কী হবে, তা নিয়ে পণ্ডিতেরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করবেন, মূল্যবান পরামর্শ দেবেন। কিন্তু আমজনতার পক্ষ থেকে আমরা সরকার ও বিরোধী দলের সহূদয় বিবেচনার জন্য কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করছি।
১. যেকোনো মূল্যে সংসদকে কার্যকর রাখতে হবে। ২. বিরোধী দলের সংসদ বর্জন করা চলবে না। সরকারের বিরুদ্ধে তাদের, যা বলার সংসদেই বলতে হবে। ৩. সংসদে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে আলোচনা হতে হবে এবং বিরোধী দলকে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে ৪. সংসদের ভাষা হবে শালীন, তথ্যপূর্ণ ও যুক্তিনির্ভর। ৪. প্রয়াত নেতাদের নামে কুৎসা রটনা করা যাবে না। ৪. সংসদ কার্যোপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে সংসদনেত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী উপস্থিত থাকবেন (অধিবেশনের বাইরে এটিই হয়তো তাঁদের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ার একমাত্র স্থান)। ৫. অধিবেশনে গরহাজির থেকে সাংসদেরা বেতন-ভাতা নিতে পারবেন না। ৫. সংসদীয় কমিটির সভায় যেসব সুপারিশ ও প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, সে বিষয়ে মন্ত্রণালয় তথা নির্বাহী বিভাগের বক্তব্য জনগণকে জানাতে হবে। আবার সংসদীয় কমিটি কোনো অন্যায় আবদার করলে মন্ত্রণালয় তাও জনগণের কাছে প্রকাশ করবে। ৬. উন্নত দেশগুলোয় বিরোধী দলের ‘ছায়া মন্ত্রিসভা’ থাকে। নির্দিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কে অভিজ্ঞ নেতারা তথ্য-প্রমাণসহ সমালোচনা করবেন এবং পাশাপাশি পরামর্শও দেবেন। ৭. বিরোধী দলের সাংসদদের প্রতি প্রশাসন বৈরী আচরণ করতে পারবে না।
সংসদের বাইরে যেসব বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দল একমত হতে পারে, সেগুলো হলো: ১. পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ করতে দেওয়া। ২. আন্দোলনের নামে বিরোধী দলের হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট, রাস্তায় গাড়ি ভাঙচুর না করা। তবে জনগণের দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে না, এমন নিয়মতান্ত্রিক, অহিংস ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি বিরোধী দল পালন করতে পারবে। রাস্তায় নামলেই পুলিশ, বিডিআর দিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের লাঞ্ছিত করা যাবে না। ৩. জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত বেতার-টিভিতে মুক্ত বিতর্কের ব্যবস্থা থাকবে, যাতে সরকারি ও বিরোধী দল সমান সুযোগ পাবে। ৪. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাজের সমালোচনা করা যাবে, তবে ব্যক্তিগত আক্রমণ করা যাবে না। ৫. রাজনৈতিক কারণে কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা যাবে না। অতীতের রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারেও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারবে না। ৬. সরকার ও সরকারি দলের বিভাজন রেখা আরও স্পষ্ট করতে হবে। ৭. প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ কোনো সরকারি অফিস বা ভবনে দলীয় সভা, বৈঠক করা যাবে না। ৮. সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত কোনো ভবনে দলীয় পতাকা, ব্যানার টানানো যাবে না। ৯. ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে কাউকে দলে নেওয়া যাবে না। ১০. সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ থেকে গণমাধ্যমকে মুক্ত রাখতে হবে। ১১. গণমাধ্যমের (ইলেকট্রনিক মিডিয়া) লাইসেন্স দেওয়া ও বাতিল করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারবে না। ১২. বিচার বিভাগের ওপর কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা যাবে না। ১৩. জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ করা যাবে না। ১৪. দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্বল করা যাবে না। ১৫. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৬. যেকোনো রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নের আগে সরকারকে বিরোধী দলের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে।
এ প্রস্তাবগুলো আমাদের মনগড়া নয়। আজ যাঁরা সরকারে আছেন, বিরোধী দলে থাকতে তাঁরাও এসব বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। আবার বিরোধী দল এখন যেসব দাবি সামনে নিয়ে আসছে, ক্ষমতায় থাকতে তারা তা আমলেই নেয়নি। গণতন্ত্রে এ বৈপরীত্য চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক নীতি, আদর্শ, মূল্যবোধ তো সব সময়ের জন্য অভিন্ন। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে তা বদলে যেতে পারে না।
সরকার ও বিরোধী দল আন্তরিক হলে দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এ ধরনের একটি সনদ প্রণয়ন করা অসম্ভব নয়। ছদ্মবেশী সামরিক শাসন থেকে মুক্তি পেতে ২০০৬ সালের ১৫ মে পিপিপির নেত্রী বেনজির ভুট্টো ও মুসলিম লীগের নেতা নওয়াজ শরিফ লন্ডনে ‘গণতন্ত্র-সনদ’-এ সই করেছিলেন বলেই আজ পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তার আলোকে সরকারি ও বিরোধী দল মিলে সংবিধানের অষ্টাদশ সংশোধনীও পাস করেছে। অথচ একদা এ দুই দলের নেতাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। এক দল আরেক দলকে ক্ষমতা থেকে হটাতে সামরিক বাহিনীকেও উসকে দিয়েছিল। দেরিতে হলেও পাকিস্তানি রাজনীতিকদের বোধোদয় ঘটেছে। বাংলাদেশের নেতা-নেত্রীদের চৈতন্যোদয় ঘটবে কবে?
গণতন্ত্র মানে দলীয় শাসন নয়। নির্বাচনের অর্থও এ নয় যে পাঁচ বছরের জন্য এক দল দেশটা লিজ নিয়েছে, পাঁচ বছর পর আরেক দল লিজ নেবে। সবকিছু ওলটপালট করে দেবে। গণতন্ত্র মানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, আইনকে খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করা নয়। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা এত দিন দ্বিতীয়টাই করে এসেছেন, এখনো করছেন। গণতন্ত্রের নামে এই জবরদস্তির রাজনীতির অবসান ঘটাতেই একটি আচরণবিধি বা ‘গণতন্ত্র-সনদ’ চাই, যাতে সরকার ও বিরোধী দলের কার্যবিধি ও সীমারেখা নির্দিষ্ট থাকবে, কেউ তার বাইরে যেতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ দার্শনিক-লেখক বার্ট্রান্ড রাসেলের একটি কথা মনে পড়ছে। বিশ্বে অব্যাহত সংঘাত-সংঘর্ষের স্থলে শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, ‘সবকিছুই বাস্তব হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা একে বাস্তব হয়ে উঠতে দিই। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অথবা মূর্খতাপ্রসূত পরিসমাপ্তি—কোনটাকে বেছে নেব তা নির্ভর করছে নেতাদের ওপরই’।
রাসেলের কথাটি আমাদের নেতানেত্রীদের জন্য আরও বেশি সত্য।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.