বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৪০২ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। শহীদ খন্দকার রেজানুর হোসেন, বীর বিক্রম গোয়াইনঘাটে শহীদ হন রাতের অন্ধকারে মুক্তিযোদ্ধারা নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে থাকলেন গোয়াইনঘাটের উদ্দেশে। তাঁরা কয়েকটি দল। একটি দলে আছেন খন্দকার রেজানুর হোসেন।
তিনি মেশিনগান প্লাটুনের সহ-মেশিনগান চালক।
গোয়াইনঘাটে আছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বড় একটি ঘাঁটি। বেশ শক্তিশালী। প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, আজাদ কাশ্মীর ফোর্স, পাঞ্জাব রেঞ্জার ও টসি ব্যাটালিয়ন সমন্বয়ে গড়া মিশ্রবাহিনী। এদের সঙ্গে আছে বিপুলসংখ্যক এ দেশীয় রাজাকার। এ ছাড়া আছে ফিল্ড ও মিডিয়াম আর্টিলারি।
সিলেট জেলার অন্তর্গত গোয়াইনঘাট। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী উপজেলা। সুরমা নদী উপজেলা সদরকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। নদীর পূর্বপারে পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ। তিন দিক ঘেরা সুরমা নদী পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরক্ষাকে যথেষ্ট সুবিধাজনক করেছে।
২৩ অক্টোবর মধ্যরাত (তখন ঘড়ির কাঁটা অনুসারে ২৪ অক্টোবর)। মুক্তিযোদ্ধারা নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সীমান্ত এলাকা থেকে গোয়াইনঘাটের কাছাকাছি পৌঁছলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে গেল। ভোরে পাকিস্তানি সেনারা তিন দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর একযোগে আকস্মিক আক্রমণ চালাল। একটি দল গোয়াইনঘাট-রাধানগর সড়ক এলাকার দিক থেকে, অপর দল নদী পার হয়ে পশ্চিম দিক থেকে, আরেকটি লেংগুয়া গ্রাম বাইপাস করে এসে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পশ্চিম দিকের আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ল। এই অবস্থানেই মেশিনগান নিয়ে চালকের সঙ্গে ছিলেন খন্দকার রেজানুর হোসেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা বেশির ভাগ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন। একপর্যায়ে দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধাদের ওই অবস্থানে শুধু খন্দকার রেজানুর হোসেন ও মেশিনগান চালকসহ কয়েকজন আছেন।
পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মধ্যে মাথা তোলাও যাচ্ছে না। কিন্তু খন্দকার রেজানুর হোসেন ও মেশিনগান চালক এতে দমে গেলেন না। মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে থাকলেন। তাঁদের সাহসিকতায় সাময়িকভাবে থেমে গেল পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রা। একসময় পাকিস্তানি সেনারা তাদের মেশিনগানের অবস্থান চিহ্নিত করে তাঁদের অবস্থানে দুই ইঞ্চি মর্টারের আক্রমণ চালায়। তাতেও তাঁরা বিচলিত হননি। মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ অব্যাহত রাখেন। কিন্তু বেশিক্ষণ পারেননি।
পাকিস্তানি সেনারা দুই ইঞ্চি মর্টারের গোলা ছুঁড়ে খন্দকার রেজানুর হোসেনদের ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। সেই সুযোগে পাকিস্তানি সেনাদের আরেক দল অনবরত তাঁদের ওপর গুলি চালায়। তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে তাঁরা দুজনই শহীদ হন। সেদিন খন্দকার রেজানুর হোসেন ও মেশিনগান চালকের দুঃসাহসিকতায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান।
খন্দকার রেজানুর চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৭১ সালে এই রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাস। মার্চ মাসে রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টার কোম্পানি ছাড়া অন্যান্য কোম্পানিকে (এ, বি, সি, ডি) সেনানিবাসের বাইরে মোতায়েন করা হয়। তিনি ছিলেন হেডকোয়ার্টার কোম্পানির মেশিনগান প্লাটুনে। নবীন সৈনিক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বিদ্রোহ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য খন্দকার রেজানুর হোসেনকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৭৩।
শহীদ খন্দকার রেজানুর হোসেনের পৈতৃক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার উপজেলার লাউহাটি ইউনিয়নের পাচুরিয়া গ্রামে। অবিবাহিত ছিলেন। তাঁর বাবার নাম খন্দকার হায়দার আলী, মা সৈয়দা রোকেয়া বেগম।
খন্দকার রেজানুর হোসেনের একমাত্র ভাই খন্দকার সরওয়ার হোসেন বলেন, ‘শহীদ পরিবারের সদস্য হয়েও সরকারের কাছ থেকে আমরা কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি।’
শহীদ খন্দকার রেজানুর হোসেনের ছবি পাওয়া যায়নি।
সূত্র: প্রথম আলোর সখীপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি ইকবাল গফুর এবং অপারেশন গোয়াইনঘাট, লে. কর্নেল এস আই এম নূরন্নবী খান বীর বিক্রম।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.