তাঁরা ছিলেন অন্ধ ও নির্বাক by মনজুরুল আহসান বুলবুল

গণমাধ্যমজগৎ কি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে? প্রশ্নটি ছিলই। কিন্তু বিশেষ করে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের পরীক্ষামূলক সম্প্র্রচার বন্ধ এবং হালে একটি টেলিভিশনের সম্প্রচার পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া নিয়ে আবার বিষয়টি সামনে এসেছে।


রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে টেলিভিশন সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার চিত্রটি আমাদের স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে। ২০০২ সালে কী ভয়াবহ প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল একুশে টেলিভিশন। বলা হয়, আদালতের রায়ে একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এটি নির্জলা মিথ্যাচার। আদালত একুশের লাইসেন্স-প্রক্রিয়ায় কিছু ত্রুটি ধরেছিলেন, স্পষ্টভাবে রায়ে বলেছিলেন: আদালতের রায় ত্রুটি সংশোধন করে একুশে চালু রাখার ক্ষেত্রে বাধা হবে না। কিন্তু তৎকালীন সরকার কী দ্রুততায় একুশে বন্ধ করে দিয়েছিল, কী ভয়ানক প্রতিহিংসার কারণে একুশে টেলিভিশনের স্বপ্নদ্রষ্টা এ এস মাহমুদকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল, কী অস্বাভাবিক দ্রুততায় বাংলাদেশের বন্ধু সায়মন ড্রিংয়ের এ দেশে কাজ করার অনুমতি বাতিল করে তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, তা এ দেশের মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। তবে অত বড় দুর্যোগের পরও একুশের কর্মীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাননি।
একুশে বন্ধ করার প্রকাশ্যে-নেপথ্যের নানা প্রক্রিয়ায় জড়িতরা যখন আজ নানা পরিচয়ে গণমাধ্যমজগতে প্রতিহিংসার ছায়া দেখতে পান, তাঁদের শুধু বলি, এমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর নৈতিক অধিকার তাঁদের নেই। কারণ, ২০০২ সালে শুধু রাজনৈতিক আনুগত্যের কারণে তাঁরা ছিলেন অন্ধ ও নির্বাক।
শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে কোনো চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়া হলে এ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই তা করতে পারত। সাবেক সরকারের শীর্ষ মহলের আরও দৃশ্যমান ঘনিষ্ঠজনের মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেল এর শিকার হতে পারত। তেমনটি হয়নি। বরং আগের ক্ষমতাধরদের সঙ্গে বর্তমানের ক্ষমতাধরদের মেলবন্ধনই তো দেখছে জাতি। দেখা যাচ্ছে, চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের হাতে আইনি যুক্তিটি বেশ দৃঢ়। যেমনটি অনেকে বলছেন, সরকার এত দৃঢ় অবস্থান না নিলেও পারত। হয়তো পারত। কিন্তু আমরা তো তেমন দৃষ্টান্ত অতীতে দেখিনি। দেখা যাক আইনি লড়াইয়ে পাল্লা কোন দিকে হেলে।
গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমার উদ্বেগ অন্য জায়গায়, সেটি হচ্ছে সহকর্মীদের নিয়ে। সর্বোচ্চ শিক্ষা নিয়ে তাঁরা নিশ্চিন্তে ঝামেলাহীন যেকোনো পেশা বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু তাঁরা স্বেচ্ছায় যোগ দিলেন এমন একটি পেশায়, যে পেশার চরিত্রের কারণেই অনেক ঝুঁকি তাঁদের নিতে হয়। পেশাগত ঝুঁকি নিতে তাঁদের কারোরই অনাগ্রহ নেই, কিন্তু কাজ করার ক্ষেত্রটিই বন্ধ হয়ে যাবে, এমন ঝুঁকি তো প্রত্যাশিত নয়। দেশের টেলিভিশন সাংবাদিক-কর্মীদের বারবার এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির শিকার হতে হচ্ছে।
একুশে টেলিভিশন-সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছিল, এর লাইসেন্স দিতে যে টেন্ডার-প্রক্রিয়া ছিল, তাতে কিছু অসংগতি পাওয়া গেছে। তবু ভালো, একুশেকে একটি টেন্ডার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছিল! টেন্ডার-প্রক্রিয়া থাকলে যেহেতু ঝামেলা হয়, সে জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার টেন্ডার-প্রক্রিয়াই বন্ধ করে দিল। টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় শুরু হলো অরাজকতা। রাজনৈতিক আনুগত্যই হলো এ লাইসেন্সপ্রাপ্তির যোগ্যতার একমাত্র মাপকাঠি। ক্ষমতার পালাবদলে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে অনেক কিছু বদলে দিতে চাইলেও এই অরাজকতাকে ধারণ করল উত্তরাধিকার হিসেবে। এ আমলেও যাঁরা লাইসেন্স পেলেন, তাঁদের নেপথ্য বড় পরিচয় রাজনৈতিক আনুগত্য। কেন এ পরিস্থিতি? দেশে দ্রুত ইলেকট্রনিক মিডিয়া বিকশিত হচ্ছে (টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন সংবাদ পত্রিকা এজেন্সি) কিন্তু দেশটিতে কোনো সম্প্রচার আইন বা নীতিমালাই নেই। ফলে সরকার যেমন সুযোগ নিচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক পরিচয়ের দুর্বৃত্তদের সামনে প্রকৃত বিনিয়োগকারীরা দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও পাচ্ছেন না। এ নিয়ে কথা হয়েছে অনেক, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
দেশের গণমাধ্যমের জন্য এ মুহূর্তে কয়েকটি মৌলিক কাজ দ্রুতই করা উচিত বলে মনে করি।
প্রথমত, সংবাদপত্রের জন্য একটি জাতীয় নীতিমালা তৈরি। এই নীতিমালা না থাকায় কালো টাকার খপ্পরে পড়ছে গোটা শিল্প, আর সাংবাদিকতার কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই অনেকে হয়ে যাচ্ছেন পত্রিকার সম্পাদক/প্রকাশক। কয়েকটি কলাম লিখে বা মালিকের স্বজন হয়ে পত্রিকার সম্পাদক হওয়া ঠেকাতেই দ্রুত এই নীতিমালা জরুরি।
দ্বিতীয়ত, সংবাদপত্রশিল্পের জন্য ১৯৭৪ সালে প্রণীত নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশনস অব সার্ভিসেস) এই আইনটি পুনরুজ্জীবিত করা এবং আধুনিক করা জরুরি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে শ্রম আইন সংশোধনের নামে এই আইনটি বাতিল করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, আইন ও গঠনবিধি সংশোধন করে প্রেস কাউন্সিলকে আরও ক্ষমতাশালী ও কার্যকর করা। প্রেস কাউন্সিল যেন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক দুই মাধ্যমের জন্যই কাজ করতে পারে, সেভাবে এর আধুনিকায়ন করা।
চতুর্থত, জাতীয় সম্প্রচার আইন ও সম্প্র্রচার নীতিমালা প্রণয়ন, যাতে টাকা থাকলেই বা কয়েকটি টক শো করেই যে কেউ টেলিভিশনের মালিক বা প্রধান নির্বাহী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে না পারেন।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম দলন-পীড়নের ইতিহাস যেমন আছে, তেমনই কঠিন সময়ে আমাদের সম্পাদক-সাংবাদিকদের গর্জে ওঠার ঐতিহ্যও আছে। কিন্তু অন্ধ আনুগত্য এবং শুধু প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে গিয়ে সেই ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে। পেশাদার সাংবাদিকদের লড়াইটি তাই দুই ফ্রন্টে। ক্ষমতার সব নেতিকে যুঝতে হবে সাহস ও শক্তি দিয়ে, পাশাপাশি কালো টাকা ও দুর্বৃত্ত মালিকানা এবং অন্ধ আনুগত্যের কলুষতা থেকেও সাংবাদিকতা/গণমাধ্যমকে রক্ষা করা তাদের জরুরি কর্তব্য।
মনজুরুল আহসান বুলবুল: সাংবাদিক।
bulbulahsan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.