শিক্ষা-বিদ্যালয়ে শিশু নির্যাতন আর কত? by মোঃ সিদ্দিকুর রহমান

মারধর করলে শিশুর অঙ্গহানি ঘটে, লেখাপড়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখা দেয় এবং সে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মারের ভয়ে শিশু পড়া মুখস্থ করে_ একথা সত্য, তবে তার জ্ঞান অর্জন বা জ্ঞানের বিকাশ সাধন হয় না
শিক্ষা মানুষকে যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তির পথ বাতলে দেয়।


মানুষ তার অধিকার নিশ্চিতকরণের পথ তৈরি করে নেয়। অধিকার অর্জনের পথ খুব মসৃণ, তা বলা যাবে না। এই পথ অবলম্বনে বাধা-বিপত্তি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এ বাধা দূরীকরণে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করার কথা_ সেই শিক্ষক সমাজই এ নির্যাতনের ধারায় সম্পৃক্ত। 'সরষের ভেতরে ভূত'_ এর বাস্তব উদাহরণ। শিক্ষকরা নিজেরা যেমন মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন, আবার তেমনি তারাও শিশু নির্যাতনের মতো অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছেন। রাষ্ট্র, সমাজসচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যভাবে বলতে গেলে দেশের শিক্ষিতের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশু নির্যাতনের ব্যাপারে সর্বমহল সজাগ। সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেই দেশব্যাপী হইচই পড়ে যায়। খোলা চোখে দেখলে মনে হয়, শিশু নির্যাতনের ব্যাপকতা কমেছে। তবে বাস্তব চিত্র এখনও হতাশাব্যঞ্জক। শিক্ষক সমাজ সারাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে। আর এ কারণে সরকার তাদের ওপর নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছেন। সরকারের এ প্রশংসনীয় কার্যক্রমে শিক্ষক সমাজ সহযোগিতা করে আসছে। অথচ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে যে শিশু নির্যাতন হয়ে আসছে তা নিয়ে কি আমরা কেউ কিছু ভাবছি? শিক্ষার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ, শিক্ষকের প্রতি অতিরিক্ত আস্থা কিংবা শিক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা যে কারণেই হোক না কেন, অভিভাবকরা সন্তানদের শিক্ষাগৃহে পাঠিয়ে শিক্ষকদের বলতেন, 'হাড্ডিটা আমার, মাংসটা আপনার।' অর্থাৎ শিশুকে পিটিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে দেওয়ার সার্বিক দায়িত্ব শিক্ষকের ওপর ন্যস্ত ছিল। আমাদের অধিকাংশের বদ্ধমূল ধারণা হলো, মারধর করে শিশুকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব। মারধর করলে শিশুর অঙ্গহানি ঘটে, লেখাপড়ার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দেখা দেয় এবং সে পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মারের ভয়ে শিশু পড়া মুখস্থ করে_ একথা সত্য, তবে তার জ্ঞান অর্জন বা জ্ঞানের বিকাশ সাধন হয় না। সরকারি প্রজ্ঞাপন সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আজও নির্দেশিকা কাঠির ব্যবহারে শিশুদের শাস্তিদান অব্যাহত রয়েছে। অনেক বিদ্যালয়ে এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশ্ন করা হলে শিক্ষকরা শিশুদের যন্ত্রণা লাঘবের জন্য নির্দেশনা কাঠিকে বেত্রাঘাত হিসেবে ব্যবহার করেন বলে জানান। তারা বলেন, 'স্যার, বেত ছাড়া কীভাবে পড়াব? বাচ্চাদের ক্যাচম্যাচ একমাত্র বেত দ্বারাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।' শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এ পেশার কাঠিন্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেই শিক্ষকতা পেশায় আসা উচিত বলে আমি মনে করি। শিশুরা তাদের স্বভাবসুলভ নিয়মে কথা বলবে_ এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষক ছাত্রের বল্পুব্দ হবেন, প্রভু নন। অন্যদিকে কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোতে শারীরিক শাস্তি না থাকলেও বর্ণনাতীত মানসিক শাস্তি থেকে শিশুরা রেহাই পায় না। এ মানসিক শাস্তি হলো শিশুর ওপর অমানবিক বইয়ের বোঝা ও অমনোবিজ্ঞানসম্মত পড়ার চাপ, যা তথাকথিত জ্ঞান অর্জনের নামে শিশুর মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ-২০১০ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুর মানবিক বিকাশ ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তুর মান বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। পাশাপাশি বিদ্যমান পাঠ্যক্রমকে বয়সের তুলনায় বোঝা হিসেবে অভিহিত করে_ এর পরিসর কমিয়ে আনার সুচিন্তিত পরামর্শও দিয়েছেন। যাতে শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষাপ্রাপ্তি আরও সহজ ও কার্যকর হয়। তিনি দৃঢ়ভাবে আরও বলেন, সুবিশাল পরিসরের পাঠ্যসূচি ও বেশি বেশি বই হলেই শিশুদের সুশিক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হবে না। একদিকে তাদের পাঠ্য বিষয়বস্তু হবে সংক্ষিপ্ত ও কার্যকর, অন্যদিকে তাদের শেখানোর পদ্ধতিও হতে হবে মজার এবং আনন্দদায়ক। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, 'প্রচুর বই দিয়ে আমরা আশা করতে পারি না যে, শিশুরা সব পণ্ডিত হয়ে যাবে।' দীর্ঘ এক বছর পর তিনি ২০১১ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহেও একই বক্তব্য রেখেছেন। দীর্ঘ ১৬ মাসেও প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য সংশ্লিষ্টদের নজর কাড়তে ব্যর্থ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি বিধায় কিন্ডারগার্টেন ও বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে শিশুর ওপর মানসিক নির্যাতন দিন দিন বেড়ে চলেছে। শিশুর ওপর শারীরিক ও মানসিক সব ধরনের নির্যাতন শিশু অধিকারের পরিপন্থী। ২০০৯ সালের ৯ আগস্ট শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি দেওয়া নিষিদ্ধ করে একটি পরিপত্র জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নতুন নীতিমালায় নিষিদ্ধ করা শাস্তিগুলো হলো_ হাত, পা বা কোনো কিছু দিয়ে আঘাত বা বেত্রাঘাত, শিক্ষার্থীর দিকে চক বা ডাস্টার জাতীয় বস্তু ছুড়ে মারা বা আছাড় দেওয়া ও চিমটি কাটা, কামড় দেওয়া, চুল টানা বা চুল কেটে দেওয়া, ঘাড় ধাক্কা, কান টানা বা ওঠবস করানো, চেয়ার-টেবিল বা কোনো কিছুর নিচে মাথা দিয়ে দাঁড় করানো বা হাঁটু গেড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা, রোদে দাঁড় করানো বা শুইয়ে রাখা কিংবা সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানো এবং ছাত্রছাত্রীদের এমন কোনো কাজ করানো, যা শ্রম আইনে নিষিদ্ধ। নীতিমালায় বলা হয়, কোনো শিক্ষক কিংবা শিক্ষা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পাঠদানকালে কিংবা অন্য কোনো সময় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে উলি্লখিত আচরণ করবেন না, যা শাস্তি হিসেবে গণ্য হয়। এসব অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তা ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী হবে এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। উপরোক্ত অভিযোগের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর আওতায় অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। প্রয়োজনে ফৌজদারি আইনেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুরূপ প্রজ্ঞাপন জারি করে। ইতিমধ্যে শাস্তির ব্যাপকতা কমলেও কিছু উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক শ্রেণীকক্ষে যাওয়ার সময় খাতা, ডাস্টার, চকের সঙ্গে জালি বেত সঙ্গে নিতে ভোলেন না। শ্রেণীকক্ষে কথায় কথায় পশুর মতো পেটাতে কার্পণ্য করেন না। বেতের ব্যবহার ছাড়াও শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। সারাদেশে শিশু নির্যাতন বন্ধ হোক_ এ প্রত্যাশাই রইল।

মোঃ সিদ্দিকুর রহমান : সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি
 

No comments

Powered by Blogger.