মহাজোটের ঐক্য সুদৃঢ় করা প্রয়োজন by ডা. এম. এ. করীম

পত্রিকান্তে প্রকাশ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৮ ফেব্রুয়ারি) মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টি (জাপা) চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে নতুন একটি জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। মহাজোটের প্রধান আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাচারিতা আর মেনে নেবে না জাপা।


তবে জটিলতা থাকায় এখনই বিষয়টি প্রকাশ করা হচ্ছে না। গোপনে চলছে এ প্রক্রিয়া। এ জোটে থাকছে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), তরিকত ফেডারেশন, বিকল্পধারা, জাকের পার্টি ও গণফোরামের একাংশ। এর দুদিন আগে দৈনিক আমাদের সময়ে 'মহাজোটে চরম টানাপড়েন' শিরোনামে আর একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। যেভাবেই খবরগুলো প্রচারিত হোক না কেন, এর সত্যতা থাকুক বা না থাকুক, এটা কিন্তু সত্য যে ভবিষ্যতে মহাজোটের ক্ষমতা ধরে রাখতে গেলে মহাজোটকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন তো বটেই, মহাজোটের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, অসাম্প্রদায়িক দল ও বাম দলগুলোকে মহাজোটে শরিক করানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সবাই একই ধারণা পোষণ করেন বলে অনেকে মনে করছেন।
মহাজোটে এখন মহাঝামেলা। আওয়ামী লীগ এখন 'একলা চলো' নীতিতে চলছে। সমন্বয়হীন ও স্থবির মহাজোটের শরিকরা নিজেদের মূল্যায়নের হিসাব-নিকাশে এখন যন্ত্রণাকাতর। এরশাদ, মেনন, ইনু নিজ নিজ ব্যাপারে আর্তনাদ করছেন। অন্যরা নিরুপায় হয়ে ভিন্ন চিন্তাভাবনা করছেন। মহাজোটের কেন্দ্রে সমন্বয়হীনতা, তৃণমূল শরিকরা এখন উপেক্ষিত। জোটে ১৪ দলভুক্ত নেতাদের নিয়মিত বৈঠকের সিদ্ধান্ত থাকলেও সে বৈঠক হতে দেখা যায় না। এরশাদের কর্মীরা শুধু নন, স্বয়ং এরশাদ নিজেও উপেক্ষিত। অভিমান করে এরশাদকে বলতে শোনা গেছে প্রধানমন্ত্রী ডাকলে তিনি (এরশাদ) পরামর্শ দিতে পারতেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীও ডাকেন না। একমাত্র দিলীপ বড়ূয়া টেকনোক্র্যাট কোটায় প্রদীপের মতো জ্বললেও নিষ্প্রভ। বাকিদের বুকে দীর্ঘশ্বাস। মেনন এমপি হওয়া ছাড়া আর এমন কোনো দ্যুতি ছড়াতে পারছেন না। যে জাসদ সভাপতি মহাজোটের রূপকার সেই ইনুর জাসদে এখন নীরব অভিমান। মহাজোট এখন নামে আছে, কাজে নেই। জনগণের মনে প্রশ্ন_এটা কি আওয়ামী লীগের কৌশল? যখন প্রয়োজন তখন কাছে ডাকা হয়, যখন প্রয়োজন শেষ তখন দূরে রাখা হয়। কিন্তু ১৪ দল গঠনের সময় এটা চিন্তাও করেনি যে ভবিষ্যৎ এ আচরণ হবে বিমাতাসুলভ। ছোট দল বলে তখন কিন্তু আওয়ামী লীগ এ আচরণ করেনি। দল ছোট হলে কী হবে, দলে আছে অফুরন্ত সৎ ও ত্যাগী কর্মীবাহিনী। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা। বিশেষ করে জাসদে। ১৪ দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা তখনকার নেতৃত্ব অবশ্যই স্বীকার করবেন। আওয়ামী লীগ বিরাট দল নিঃসন্দেহে। কিন্তু জগদ্দল পাথর হয়ে বসা চারদলীয় জামায়াত-বিএনপি জোটকে ক্ষমতা থেকে হটানো আওয়ামী লীগের পক্ষে একা মোটেই সম্ভব ছিল না। এ কথা একটা অবুঝ শিশুও জানত। সব কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করলে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এবারের মহাজোটের নির্বাচনী বিজয় ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দলবদল নয়, আদর্শের পালাবদল। যুদ্ধাপরাধী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল, জঙ্গি ইসলামী গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানপন্থী রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে একাত্তরের চেতনায় আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের পালাবদল। জনগণের এই যে সমর্থন, এ সমর্থন আওয়ামী লীগের প্রতি নয়, একটি আদর্শের প্রতি। বলতে গেলে আওয়ামী লীগ এ আদর্শের প্রধান দল। তাই তাদের নেতৃত্বে যে ১৪ দল গঠিত হয়েছিল, সে ১৪ দলকেই মানুষ আদর্শের প্রশ্নে বিজয়ী করেছিল। এখানে একটা বিষয়ে পরিষ্কার হওয়া উচিত তা হলো, অনেকেই অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক (যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদবিহীন) বাংলাদেশ চায়; কিন্তু তারা কোনো দলের সদস্য নয়, তারাও এই মহাজোটকে ভোট দিয়েছিল। অন্যদিকে আবার একটি দলে (লিবারেল গণতান্ত্রিক দল) এমন অনেক নেতা-কর্মী আছেন ও থাকেন, যাঁদের নিয়ে বিতর্ক থাকে। অর্থাৎ কিনা দলের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা কর্মীর ভুল থাকতে পারে, কিন্তু আদর্শের ক্ষেত্রে তা থাকে না।
আমরা একটু পেছনের দিকে ফিরে তাকাই ১৯৬৯ থেকে '৭১ পর্যন্ত যে আদর্শিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল তার যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি বা মূল্যায়ন করতে পারেনি। দলের অনেক কর্মী এ আদর্শিক ভাবনা মনের মধ্যে গ্রথিত করতে পারেনি। ১৯৭২ থেকে '৭৫-এ তা বুঝতে সক্ষম হননি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী। '৭৫-এর পর থেকে রাজনৈতিক অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর যে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা এ দলের বেশির ভাগ নেতা, বিশেষ করে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পোষণ করেন, তা যদি প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হন, তবে বাংলাদেশের ভাগ্যে কী নির্মম পরিহাস লেখা আছে তা ভবিতব্য। জনগণের মন-মানসিকতার কারণে কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয় এসেছিল। একে দলীয় বিজয় ভাবলে আওয়ামী লীগ বিরাট ভুল করে বসবে এবং বাঙালি জাতিকে অন্ধকারে ভাসিয়ে দেবে। বরং বিজয়ের পর আওয়ামী লীগের যা করা প্রয়োজন ছিল তা হলো, ২০০৮ সালের ঐক্যের বাতাবরণকে কার্যকর, বিস্তৃত ও দৃঢ় করা। এখানে অনেকেই বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। কিন্তু আমি তা মনে করি না। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বিএনপির সঙ্গে তুলনীয় নয়। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে যখন গরমিল হয়ে যায় তখনই তারা এসব কথা বলে। যখন মানুষ দেখে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বুলি শুধু মুখের বুলি ও রাজনৈতিক বোলচালে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, টেন্ডারবাজি, দলীয় সন্ত্রাস, দলীয় কোন্দল, ক্ষমতার অপব্যবহার চলছেই_তখনই জনগণ ভুলে যায় যে আওয়ামী লীগ একটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল এবং তখনই দুই দলের মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পায় না। জনগণ মনে করে, শুধু যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রক্রিয়া চালিয়ে প্রমাণ করা যাবে না যে তারা মুক্তিযুদ্ধের দল। পরিপূর্ণভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, সমাজ থেকে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করে একটি যুক্তিবাদী আধুনিক মানবিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলেই হবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল। মুক্তচিন্তা বা সমাজে সাংস্কৃতিক মুক্তির জোয়ার আনতে হবে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জনগণ মহাজোটকে বিজয়ী করেছিল বহুদিনে গড়ে ওঠা রাজনীতির অবক্ষয় ও অচলায়তন থেকে মুক্তি পাবে বলে। ভেবেছিল ক্ষয়িষ্ণু-বিভ্রান্ত-স্থবির হয়ে আসা সমাজের জাগরণ ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের যে চিন্তা জনগণ করেছে, সে আদর্শের পতাকা বইবার দায়িত্ব দিয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে। কিন্তু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা দিন দিন হোঁচট খাচ্ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, মহাজোট সরকার মহাজোটের ব্যাপ্তি না ঘটিয়ে দলীয় গণ্ডির মধ্যে বাঁধা পড়েছে। ক্ষমতার ভাগ ও ভোগ নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছে। আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সংসদ কার্যকর হচ্ছে না। সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলার মতো সমস্যাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এখনো সময় আছে, আওয়ামী লীগকে যা করতে হবে তা হলো_মহাজোটের ঐক্য সুদৃঢ় করা ও সক্রিয় রাখা; তৃণমূল পর্যন্ত মহাজোটকে সক্রিয় করা; নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা; সংসদকে কার্যকর রাখার ব্যবস্থা করা; গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করা; আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন, গতিশীল ও জনগণের জন্য কল্যাণকর আমলাতন্ত্র গঠন এবং স্বাধীন-নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ কার্যকর করে সুশাসনের সরকার জনগণকে উপহার দেওয়া; সংসদে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, রাজনীতির মাঠে এবং সমাজের সর্বত্র আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সমাজ ও সরকারের অংশীদারিত্ব কার্যকর করে পর্যায়ক্রমে সরকারের ভূমিকা হ্রাস করে সামাজিক ভূমিকাকে প্রধান করে তোলা। এগুলো করা সম্ভব হবে তখনই যখন মহাজোটকে শক্তিশালী করে সমাজে সৃষ্ট আদর্শিক ঐক্য ও সমর্থনের জোয়ার ধরে রাখা ও কাজে লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। কিন্তু সরকার যদি তা না করে, তবে ভবিষ্যতে তরুণ সমাজ আবার রাজনীতিবিমুখ হয়ে উঠবে, মেধাবীরা দেশ ছাড়তে শুরু করবে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাত হয়ে যাবে। মৌলবাদ আবার বিষধর ফণা দিয়ে ছোবল দেওয়ার চেষ্টা করবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, শুধু দল নয়, মহাজোটকেও শক্তিশালী করুন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়িত করুন। জনগণের এটাই চাহিদা।
লেখক : বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট পরমাণু চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.