কথা সামান্যই-দেশপ্রেম ও সাংস্কৃতিক বন্ধন by ফজলুল আলম

কিছুদিন আগেও আমি প্রতি সপ্তাহে ছোট পর্দায় নিয়মিত 'কড়া আলাপ' নামে একটা 'টক শো' উপস্থাপনা করতাম। বর্তমানে সেটা বন্ধ আছে, কারণ আমি অসুস্থ। কিন্তু 'কড়া আলাপ'-এর পরিচিতি এখনো ম্রিয়মাণ হয়ে যায়নি। আমার আলোচনার অধিকাংশ বিষয়ই ছিল গভীরতাপূর্ণ- চুটকি জাতীয় নয়।


সেদিন সহসাই একজন প্রযোজক জানতে চাইলেন যে আমি 'দেশপ্রেম' বিষয়ে কড়া আলাপ করেছি কি না! আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। সত্যিই তো- এ বিষয়ে কখনো আলোচনা হয়নি। একবার মনে হয়েছিল; কিন্তু এই আলোচনায় নেওয়ার মতো আলোচক খুঁজে পাইনি। এখনো পাচ্ছি না। আমি নিশ্চিত যে বিষয়টা নিয়ে অনেকেই আলোচনা করতে চাইবেন। শিক্ষায়তনিক ব্যক্তিরা বইয়ের ভাষায় টিউটরিয়াল জাতীয় কথা বলবেন, আমার সেটা পছন্দ না- আবার আমার টক শো অনুষ্ঠানের সীমানা অতিক্রম করে আমি যে মাইক-ক্যামেরা সমভিব্যাহারে পথে পথে মানুষজনকে প্রশ্নটা করব, সেটাও সম্ভব হবে না। ভাবলাম, ছোট পর্দায় না হোক, কলম যখন আছে আর 'কালের কণ্ঠ' ছাপানোর উদারতা দেখাচ্ছে, তখন নিজেই কিছু লেখার চেষ্টা করে জনমত ঝালাই করে নিই না কেন। একসময় আমি নিজে দেশপ্রেম বলতে কী বুঝতাম- এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েই শুরু করি।
বহুদিন আগের কথা, ষাটের দশকের শেষভাগে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন তখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে। চার বছরের জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়েছিল। ফেরার দিন প্লেনটা দেশের মাটির কাছাকাছি নামার সময় থেকেই আমি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। প্লেনটা মাটি স্পর্শ করতেই আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। তখন সেটার বিশ্লেষণ করিনি, আজ করব। আমার সেই আবেগ কি দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ছিল?
আরো মনে পড়ল একাত্তরে যেদিন ইসলামাবাদ থেকে সপরিবারে পালালাম- (পালানোর কথা ওঠে, কারণ আমি সেখানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতাম) সেদিনও প্লেনটা টেক-অফ করার সময় কেঁদে ফেলেছিলাম। সেটাও কি দেশপ্রেমের জন্যই করেছিলাম?
দেশকে ভালোবাসা, দেশের মানুষকে ভালোবাসা, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা-নির্বিশেষে এক এলাকায় বসবাস করা মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা, ঐকান্তিকতা স্বাভাবিক হওয়ার কথা; তা না হয়ে এসবের মধ্যে বিভাজন থাকে কেন? থাকার তো কথা নয়। সেসব তাহলে কৃত্রিমভাবে তৈরি করে রাখা হয়েছে- উদ্দেশ্য নিজেদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করা। বিভাজন থাকলে সবাই মিলে একই দেশমাতৃকার বন্দনায় আর ভালোবাসায় আপ্লুত হব না কখনো। সে রকম দেশের ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে গেলে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর একতাবদ্ধতা সৃষ্টি হতে পারে। তাতে দেশের ক্ষমতাসীনদের সমূহ বিপদ আসতে পারে- তখন রাজনৈতিক শাসনকার্য, অর্থনৈতিক বিভাজন, লুটপাট, দুর্নীতি- এসব আর শক্তিশালী গোষ্ঠীর পক্ষে ঢালাওভাবে করা সম্ভব নাও হতে পারে।
সুতরাং ক্ষমতাসীনদের জন্য দেশে এমন একটা আবহাওয়া তৈরি করা উচিত, যাতে দেশের মানুষগুলো একে অপরের কল্যাণমুখী হয়ে ভালোবাসলেও সেসব যেন পুরোপুরি বৈরিতাবিহীন না হয়ে ওঠে। অর্থাৎ দেশে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে সেখানে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে জনগণের মধ্যে ঐক্য আছে, ভালোবাসা আছে; কিন্তু সেই সঙ্গে শত্রুতাও আছে! জটিল এই অবস্থা সৃষ্টি করার পর সেখানে একটা নতুন নামের প্রয়োজন হলো- নামও পাওয়া গেল 'দেশপ্রেম'। এই দেশপ্রেম জোড়া দেওয়ার প্রেম নয়, অতি সূক্ষ্মভাবে এটা ভাঙনের প্রেম। এই দেশপ্রেমে হাজার সস্তা উপকরণ আনা হয়- সর্বপ্রথম আনা হয় 'ঐতিহ্য'- সেই ঐতিহ্যের মধ্যে গাথা হয় নানা উপকথা, প্রাচীন ধ্যান-ধারণা, ঐতিহাসিক বীরত্ব গাথা, একে অপরকে নির্বংশ করে একটি 'উৎকৃষ্ট' জাতি সৃষ্টির কথা- একই ভাষা নির্ভরতা, একই ইতিহাস নির্ভরতা, একটি ভূখণ্ডের সীমানা যাতে তার পবিত্রতা বজায় থাকে। দেশের পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য তো এত সব একই সঙ্গে প্রযোজ্য হতে পারে না। তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে শ্রেণী বিভাজন আর শ্রেণী বিভাজন মানেই দেশপ্রেমের মধ্যে ফাটল আনা।
তাহলে আমার বা কারোরই কি দেশপ্রেম থাকতে পারে না? আমি কি বাংলাদেশকে সেভাবে ভালোবাসি না? আমি কেন চার বছরের অদর্শনে ঢাকার মাটিতে প্লেনের চাকা স্পর্শ করতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলেছিলাম? আমি কেন ইসলামাবাদকে নিজের দেশ মনে করে রয়ে গেলাম না? হয়তো প্রাণভয়ে পালিয়েছিলাম; কিন্তু ভয়টার উৎস কোথায় ছিল? উৎস ছিল সেই ভূখণ্ডের চৌহদ্দির মধ্যে- সেই দেশের জনগোষ্ঠীর দেশপ্রেমের মধ্যে- তাদের 'দেশপ্রেম' আর আমার দেশপ্রেমের মধ্যে ছিল শত্রুতা, নিষ্ঠুরতা একে অপরকে দাবিয়ে রাখার অভিলাষ। আমার 'দেশপ্রেম' মোটেই আমাকে অন্যদের দেশপ্রেমকে ভালোবাসতে উজ্জীবিত করে না, বরং ঘৃণা করতে শেখায়। এমনকি একই ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর দেশপ্রেম যে সবার প্রতি একইভাবে প্রযোজ্য হবে তাও সম্ভব নয়। কেন নয়? কারণ একই এলাকায় শুধু একটি সাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠী বসবাস করবে সেটা সম্ভব নয়।
তাই 'দেশপ্রেম' নয়, ভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নর-নারী একে অপরের কল্যাণে এগোবে- সেটাই হবে তাদের বসবাস করা ভূখণ্ডের জন্য শ্রেয়। সে জন্য প্রথমেই দেশপ্রেমের ধারণাটা আমাদের ফেলে দিতে হবে- আনতে হবে মানবতাবোধ, দূর করতে হবে সমাজের অসমতা, দূরীভূত করতে হবে এক গোষ্ঠীর অপর গোষ্ঠীকে শোষণ-শাসন-নিপীড়ন করে নিজেকে নিজেদের সমাজের উচ্চাসনের স্থান নিশ্চিত করা।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে দেশপ্রেমের আগে স্বাধীন ভূখণ্ডের সম্পর্ক দৃঢ় নয়। এটা অ-স্বাধীন দেশের বিবিধ বা এক সংস্কৃতিবাহক জনগোষ্ঠী মিলেমিশে সেই ভূখণ্ডের প্রতি 'দেশপ্রেম' অনুভব করতে পারে; কিন্তু আসলে সেই মিলনমুখিতা পরিচিত সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মিলনমুখিতা। একে নানাভাবে বর্ণনা করা যায়; অনেকে একে এক গোত্রের সমন্বয়তা মনে করবেন, বলবেন, অনেকে একই ভাষা, রীতিনীতি, একই ধর্মীয় বা পারিপাশ্বর্িকতাসৃষ্ট আচার-ব্যবহারের, এমনকি একই জাতিসত্তার কথা বলতে পারেন! কিন্তু কঠিন প্রশ্নটা হলো সেসব নিয়ে 'দেশপ্রেম' বা দেশাত্মবোধ হয় না।
সেই ভ্রান্ত ধারণা বা রক্ষণশীলদের দর্শন থেকে ইউরোপে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র এসেছে। আমরা প্রায় সবাই সেটাই মেনে নিয়েছি; কিন্তু এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে, এসব জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র কখনোই এক জাতিভিত্তিক ছিল না, এখানে সর্বদাই এক বা একাধিক ক্ষমতার অধিকারী গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলবল 'জাতিভিত্তিকতা'র কথা বলে তাদের রাজনৈতিক (ও সামরিক) নিরাপত্তার বলয় তৈরি করছে মাত্র।
একটু ভাবলেই দেখা যাবে যে যুদ্ধোত্তর সময়ের জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র একটা রাজনৈতিক কল্পনা- এই তথাকথিত জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রগুলো জনগণকে কয়েকটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক অভ্যাসের দাসে পরিণত করে একত্রভাবে রেখেছে। এসব শক্তিশালী সাংস্কৃতিক অভ্যাসের ঘটনাক্রমে গালভরা ও আবেগমথিত নামকরণ হয়েছে 'দেশপ্রেম'।
অতীতের ভারতবর্ষে, বর্তমান রাজনৈতিক ভারতে, বাংলাদেশে অনেক ভিন্ন জাতি ও ভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী কত না বৈপরীত্যপূর্ণ চিত্র সৃষ্টি করেছে, তবুও এখানে সব জনগোষ্ঠী একত্রেই বসবাস করছে। সেটা কি দেশপ্রেমের জন্য? আমার তা মনে হয় না- আমার বিশ্বাস এই একত্রে থাকা সম্ভব হয়েছে সাংস্কৃতিক অভ্যাসের জন্য। দেশপ্রেমের নাম করে এসব দেশে যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং পরশ্রীকাতর শ্রেণীগুলো দুর্নীতি, গুম, খুন, রাহাজানি ইত্যাদি করেও দিব্যি ক্ষমতায় বহাল তবিয়তে থাকতে পারছে। দেশের মানুষের মধ্যে সত্যিকারের অর্থে দেশপ্রেম থাকলে তাহলে এই ক্ষমতাধিকারীরা উবে যেত সেই কবে!
অবশ্য এক দেশে বা রাষ্ট্রে মিলিতভাবে বসবাস করতে হলে সাংস্কৃতিক বন্ধনগুলোকে এক হওয়ার প্রয়োজন নেই। বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ যারা উপভোগ করে, তারা কিন্তু এক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর লোক নয়, আবার এক সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর লোক হলেও সবাই বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ উপভোগ করতে পারে না। এসবের সঙ্গে দেশপ্রেম সমন্বিত থাকতেও পারে বা নাও পারে; কিন্তু শুধু দেশপ্রেমের জন্যই একটা জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠবে এমন ভাবনা বর্তমানে কাল্পনিক। জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টির পেছনে আছে নিজেদের রক্ষা করার তাগিদ- সেটা রাজনৈতিক বটে।
বাঙালি জাতিসত্তার সংস্কৃতি একমুখী- এটাও ভাবা সম্পূর্ণ যথাযথ হয় না; কারণ এই জাতিসত্তাতেও নানা বিভাজন আছে, শ্রেণীবিভেদ আছে, ভিন্ন ধর্ম বা বিশ্বাস আছে, আরো আছে পৃথক লোকাচার। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয়, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে বসবাসকারী গোত্র, গোষ্ঠী, ও জাতি একই সংস্কৃতির হয় না; তাদের বন্ধন সুদৃঢ় হয় রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও ভয়শূন্যভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত জীবনের জন্য। সেসবকে দেশপ্রেম বলে বাগাড়ম্বর করা হলে হোক।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.