দূরদেশ-বিজয়ী ইংলাকের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ by আলী রীয়াজ

থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী আবারও প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করবে কি না, দেশটির রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের কাছে এখন সেটাই বড় প্রশ্ন এবং উদ্বেগের বিষয়। ৩ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত ডেমোক্র্যাটদের পরাজয়, বিশেষত সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার ছোট বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রার নেতৃত্বাধীন


পুয়ে থাই দলের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর এই প্রশ্ন অনেকেরই মনে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদেও এমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত রয়েছে। তবে পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন যে, এমন ভাবার কোনো বাস্তব কারণ নেই। থাইল্যান্ডের ইতিহাস এ রকম আশঙ্কার পেছনে একটা বড় কারণ। ১৯৩২ সালে রাজতন্ত্রের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অবসান হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৮টি সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে ১১টি অভ্যুত্থান সফলও হয়েছে। এ সময় ১৮ বার সংবিধান তৈরি বা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ২৭ জন। তা ছাড়া, এ কথাও কমবেশি সবারই জানা যে, ২০০৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়েই ডেমোক্র্যাট পার্টি ২০০৬ সালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিল। তদুপরি গত পাঁচ বছরে থাকসিন সিনাওয়াত্রার দলকে একাধিকবার বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছে এবং তারা নতুন করে সংগঠিত হয়েছে।
থাইল্যান্ডের কোনো কোনো গণমাধ্যম এবং দেশটির রাজনীতির কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, সেনাবাহিনী পুয়ে থাই পার্টির বিজয়ে আনন্দিত না হলেও তারা শিগগিরই রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে না। কেননা, নির্বাচনের ফলাফল পুয়ে থাই পার্টির পক্ষে যাবে, এমন জনমত জরিপের পর সেনাবাহিনী ও পুয়ে থাই পার্টির মধ্যে কতক বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, যার কারণে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে সেনাবাহিনী খুব দুশ্চিন্তায় নেই। এসব খবরে বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে থাকসিনের পক্ষে ওয়াতানা মুয়াংসুক, রাজপ্রাসাদের পক্ষে রানির প্রতিনিধি জারুঙ্গজিত থিকারা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রাউইত ডংসুয়ানের মধ্যে ব্রুনাইতে এক বৈঠকে সমঝোতা হয়। এই সমঝোতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পুয়ে থাই ক্ষমতাসীন হলে তারা ২০০৬ সালের সেনা অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের এবং গত বছর ব্যাংককে সরকারবিরোধীদের ওপর যারা হামলা চালিয়ে ৯১ জনকে হত্যা করেছে, তাদের কোনো রকম বিচারের সম্মুখীন করা হবে না। বলা হয়, তিন পক্ষের মধ্যে এ বিষয়েও মতৈক্য হয়েছে যে থাকসিন সিনাওয়াত্রা ও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের ক্ষমার বিষয়টি একটি কমিশনের হাতে অর্পণ করা হবে। ‘রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এ বিষয়ে যে প্রস্তাব তৈরি করবে, তা গণভোট হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে হাজির করা হবে।
নির্বাচনের আগেই এ বিষয়ে গুজব শোনা গেলেও এর পক্ষে খুব জোর প্রমাণ ছিল না। কিন্তু নির্বাচনের পরপরই ইংলাক সিনাওয়াত্রার দল যে সাতটি অগ্রাধিকারের কথা বলতে শুরু করেছে, তাতে ‘রিকনসিলিয়েশন’ বা ‘সমন্বয়’-এর কথাও রয়েছে। থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর শক্তি ও ভূমিকা যারা সম্যকভাবে অবহিত, তাদের ধারণা যে, এ ধরনের কোনো সমঝোতা যদি তৈরি হয়ে থাকে, তবে তা থাকসিন ও ইংলাকের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়। অন্যদিকে ইংলাক সিনাওয়াত্রার সমালোচকেরা মনে করেন, এ ধরনের সমঝোতায় কোনো ফলোদয় হবে না। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা তাতে কেবল বাড়তেই থাকবে। এ বিষয়ে ইংলাক সিনাওয়াত্রার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি আসবে তাঁর সমর্থকদের মধ্য থেকেই—‘লাল শার্ট’ আন্দোলন বলে পরিচিত সরকারবিরোধী আন্দোলনকারীরাই যে পুয়ে থাই পার্টির বিজয়ের প্রধান শক্তি। গত বছরর হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার বিষয়টি তাদের পক্ষে মানা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। লাল শার্ট আন্দোলনের প্রধান ইতিমধ্যে এ নিয়ে তাঁর অসন্তোষের কথা ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনের আগে ও পরে ইংলাক সিনাওয়াত্রা সংবিধান সংশোধনের বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইংলাকের সমর্থকেরা চান, সংবিধানের বড় ধরনের পরিবর্তন করা হোক। সংবিধানের সবচেয়ে বিতর্কিত ও সমালোচিত ধারা হচ্ছে, রাজপরিবারের সদস্যদের সমালোচনা ও ‘অপমান’ করার শাস্তির বিধান। এই বিধানের আওতায় সরকারের সমালোচক ও প্রতিপক্ষদের শায়েস্তা করার ঘটনা বিরল নয়। ইংলাক ওই বিধানটি নিয়ে আলোচনা ও বিবেচনায় উৎসাহী, সংবিধানের অন্য কিছু ধারাও পরিবর্তনের পক্ষে কিন্তু সংবিধানের খোলনলচে বদলে ফেলার কাজে তিনি হাত দিতে চান না। তাঁর সমর্থকেরা তা কতটা মেনে নেবে, সেটা এখন সময়ের ব্যাপার।
ইংলাক সিনওয়াত্রা তাঁর নির্বাচনের সময় যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়ন হবে তাঁর সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি দেশের সর্বনিম্ন মজুরি ৪০ শতাংশ বাড়ানোর, কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের মূল্য ৫০ শতাংশ বাড়ানোর এবং প্রতিটি হাইস্কুলের ছাত্রকে একটি ট্যাবলেট কম্পিউটার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ধরনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে দ্রুত সাফল্য দেখাতে না পারলে পুয়ে থাই পার্টির বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ কথা ভুলে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই যে এই ফলাফল থাই সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যে দূরত্ব তা আবারও তুলে ধরেছে। পুয়ে থাই (এবং এর পূর্বসূরি দল) সমাজের যে শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করছে, তারা প্রধানতই গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত। থাকসিনের জনপ্রিয়তাও তাদের মধ্যেই।
অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যেই বেশি জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, ৩ জুলাইয়ের নির্বাচনে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই পুয়ে থাই সবচেয়ে ভালো করেছে। উত্তরাঞ্চলের ১৯৫টির মধ্যে ১৫৩টি এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১২৬টির মধ্যে ১০১টি আসন পেয়েছে তারা। ডেমোক্র্যাটরা ব্যাংকক ও দক্ষিণের ৮৬টির মধ্যে ৭৩টি আসন পেয়েছে। ব্যাংককের ৩৩টি আসনের মধ্যে ২৩ আসন পেয়েছে ডেমোক্র্যাটরা, যে ১০টি পুয়ে থাই পেয়েছে, তাও শহরের দরিদ্র এলাকায়। এই সমর্থকগোষ্ঠীর সমর্থন অব্যাহত রাখতে হলে তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। ইংলাক সিনাওয়াত্রা ও তাঁর দল তাতে সফল না হলে ডেমোক্র্যাট দল ও এর সমর্থকেরা নিশ্চয়ই এর সুযোগ নেবে। এটাও মনে রাখা দরকার, ক্ষমতাসীনেরা যদি কেবল তার সমর্থক শ্রেণী ও গোষ্ঠীকেই সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে, তবে তা তাদের বিরোধীদের ক্ষুব্ধ করবে এবং দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির পথ খুলে দেবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতেই ২০০৬ সালে থাকসিন সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে সেনা অভ্যুত্থান ঘটেছিল।
এসব থেকে স্পষ্ট যে থাইল্যান্ডের সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রার জন্য সামনের দিনগুলো কঠিন পরীক্ষার সময়। তাঁর দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৫০০ আসনের মধ্যে ২৬৫টি) এবং তাঁর কোয়ালিশনের সদস্যদের নিয়ে মোট আসন ২৯৯-এ পৌঁছার কারণে যাঁরা মনে করছেন সেনাবাহিনী ও বিরোধীদের নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, তাঁদের স্মরণ করা দরকার, ২০০৬ সালে থাকসিন সিনাওয়াত্রা যখন ক্ষমতাচ্যুত হন, তখন সংসদে তাঁর দলের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩৭৭টি আসন। ইংলাক সিনাওয়াত্রা ও পুয়ে থাই তাঁদের সামনে উপস্থিত চ্যালেঞ্জগুলো কীভাবে মোকাবিলা করেন, সেটাই নির্ধারণ করবে সেনাবাহিনী আবারও রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে কি না।

ইলিনয়, ৬ জুলাই ২০১১
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভারসিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.